২০শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সরকার ‘প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয়’ রেখেছে যাতে অরাজক পরিস্থিতি থাকে: যুবদল সভাপতি

অনলাইন ডেস্ক: পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে প্রকাশ্যে মাথা থেঁতলে ভাঙারি ব্যবসায়ীকে হত্যার ঘটনার মূল আসামির গ্রেপ্তার না করা ও এজাহার থেকে বাদ দেওয়া ‘রহস্যজনক’ বলেছেন জাতীয়তাবাদী যুবদলের সভাপতি এম মোনায়েম মুন্না। বিএনপির তিন সংগঠন যুবদল, জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সরকার ‘পরিকল্পিতভাবে প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয়’ রেখেছে যাতে দেশে ‘অরাজক পরিস্থিতি থাকে এবং এই অজুহাতে নির্বাচন বিলম্বিত করা যায়।ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যার ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে শনিবার জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকে বিএনপির তিন সংগঠন।বেলা সাড়ে ১১টায় সংবাদ সম্মেলনে এসে যুবদল সভাপতি বলেন, “এই ঘটনায় যারা সরাসরি সংশ্লিষ্ট, ভিডিও ফুটেজ ও সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে যাদের দেখা গেছে আশ্বর্য্জনকভাবে তাদের মামলার প্রধান আসামি করা হয়নি। যারা প্রাণঘাতি আঘাতগুলো করেছে তারা অদ্যাবধি গ্রেপ্তারও হয়নি। এর কারণ আমাদের বোধগম্য নয়।”
বুধবার বিকালে মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর ফটকের সামনে প্রকাশ্যে কংক্রিট বোল্ডার দিয়ে শরীর ও মাথা থেঁতলে হত্যা করা হয় ভাঙারি ও পুরনো তারের ব্যবসায়ী মো. সোহাগ ওরফে লাল চাঁদকে। এ ঘটনায় বিএনপির তিন সংগঠনের পাঁচজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের তিনজন আসামি।যুবদল নেতা মুন্না সংবাদামাধ্যমে আসা বাদীর মেয়ের বক্তব্যের প্রসঙ্গ টানেন। মেয়েটি বলেছেন, মামলার এজহারে খুনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত তিন খুনিকে ‘পুলিশ কৌশলে বাদ দিয়ে নিরাপরাধ তিনজনকে আসামি করেছে’।
মুন্না বলেন, “ঘটনার ৬০ ঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও, খুনের প্রমাণ হাতে থাকা সত্ত্বেও অদ্যাবধি মূল আসামিদের গ্রেপ্তার করা গেল না… এটা একটি বিরাট প্রশ্ন ও রহস্য।“আপনাদের (সংবাদমাধ্যম) মাধ্যমে আমরাও জানতে চাই, কারা কেন এই তিন আসামিকে বাদ দিয়ে নতুন করে অন্য তিনজনকে আসামি করল, এটা আমরা জানতে চাই। আর ঘটনাটি বুধবারের। গতকাল শুক্রবার এই ঘটনা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। দুই দিন আগের ঘটনা, কেন দুই দিন পর প্রচার হল, এর পেছনে কারা জড়িত সেটাও খুঁজে দেখা উচিত।”এ বিষয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দাবি জানান যুবদল সভাপতি।ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যাকাণ্ড এবং তার পরের ঘটনাপ্রবাহের বেশ কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছে। সেসব দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছে মানুষ, তৈরি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ।এই ঘটনায় শুক্রবার পুলিশ চারজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য দিয়েছে।
ঢাকার নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সংবাদ সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসে মোনায়েম মুন্না দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। মিটফোর্ডে সোহাগ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান তিনি।
মুন্না বলেন, “এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ইন্ধনদাতা হিসেবে যাদের নাম এসেছে, মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তার মধ্যে আমাদের তিন সংগঠনের পাঁচজনকে গতকাল আজীবনের জন্য বহিস্কার করেছি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছি অতি দ্রুত তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার জন্য।“সাংগঠনিক দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার জায়গা থেকে যা কিছু প্রয়োজন আমরা সেই ব্যবস্থাগুলো নিয়েছি।”‘অভিযোগ পেলে কাউকে ছাড় দিচ্ছি না’
মুন্না বলেন, “গত কয়েক মাসে সারাদেশের যেকোন জায়গা থেকে যখনই আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, আমরা অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেলেই চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। গত প্রায় এক বছরে আমরা আমাদের হাজারো নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছি।”
দায় এড়ানোর রাজনীতি করেন না দাবি করে যুবদল সভাপতি বলেন, তারা বরং দায় গ্রহণ করে সর্বোচ্চ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু হাজারো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা হলেও প্রশাসন কি তাদের বিষয়ে যথাযথ আইনি বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়েছে- এই প্রশ্ন তোলেন তিনি।ব্যবস্থা না নিয়ে থাকলে কেন নেয়নি প্রশাসনের কাছেও তাও জানতে চান মুন্না।
অভিযোগ করে যুবদল নেতা বলেন, “বর্তমানে প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিপর্যস্ত। কিন্তু একটি সুযোগসন্ধানী বিশেষ গোষ্ঠী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বাছাই করা কিছু ঘটনার প্রতিবাদ করে। তারা বিএনপি ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং তীব্র কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য বিবৃতি দেয়া শুরু করেছে।”
বিএনপি ইতোমধ্যে দুষ্কৃতকারীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে সরকার ও প্রশাসনকে অসংখ্যবার অনুরোধ করেছে দাবি করে তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সরকার ও প্রশাসন ‘মারাত্মকভাবে ব্যর্থ’ হচ্ছে।“আমরা মনে করি, সরকার পরিকল্পনামাফিক প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে যাতে দেশে অরাজক পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকে এবং এই অজুহাতে জাতির দীর্ঘ প্রত্যাশিত জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করা যায়।“একটি বিশেষ গোষ্ঠী যারা নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে উত্তরণ চায় না, তারা এই সুযোগটি গ্রহণ করে বিএনপি এবং বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার উস্কানি দিচ্ছে।”


মুন্না বলেন, “তারা (বিশেষ গোষ্ঠী) চায় দেশে আরও অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হোক। সরকারের একটি অংশ তাদের এই দুরভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনার অংশ হয়ে অপরাধ দমনে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কোন দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।“আমরা বারবার অনুরোধ করার পরেও দুষ্কৃতকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়নি।”
দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর হওয়ার কোন বিকল্প নেই মন্তব্য করে মুন্না বলেন, “আপনারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিকল্পে কার্যকর পদক্ষেপ নিন৷ এখানে আমাদের যদি কোনো ধরণের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, আমরা তা করতে সর্বদা প্রস্তুত আছি।”জনগণকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, “আইনশৃঙ্খলার নাজুক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কোনো সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক দল বা অগণতান্ত্রিক শক্তি যাতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সেই বিষয়ে অনুগ্রহপূর্বক সতর্ক থাকুন।”
‘আরব বসন্তের’ কথা তুলে ধরে যুবদলের এই শীর্ষ নেতা বলেন, “একসময় আরব বসন্ত শুরু হয়েছিল তিউনিসিয়ায়। কিন্তু বেন আলীর পতন হলেও সেখানে ১৫ বছরেও প্রত্যাশিত শান্তি ও স্থিতিশীলতা আসেনি। আমাদের এখানেও যারা ধারাবাহিকভাবে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা জারি রেখে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়, তাদের অসৎ উদ্দেশ্যের বিষয়ে সতর্ক থাকুন।”
গত ৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের তিন দিন পর দেশের হাল ধরে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।এর পর বিভিন্ন সময় মব সৃষ্টি করে হামলা-হত্যার ঘটনা ঘটেছে। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি।যুবদল নেতা মুন্না বলেন, “গত প্রায় এক বছরেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি তো দূরের কথা, সাধারণ মানুষের জীবনের নূন্যতম নিরাপত্তাও নিশ্চিত হয়নি।”শুক্রবার খুলনায় যুবদলের একজন বহিষ্কৃত নেতাকে গুলি করে ও রগ কেটে হত্যা, চাঁদপুরে খুতবা দেওয়ার সময়ে একজন ইমামের ওপর হামলার ঘটনা তুলে ধরেন তিনি।“আপনারা দেখেছেন, রগ কেটে হত্যা করা একটি বিশেষ সংগঠনের দীর্ঘদিনের সহিংস রাজনীতির চর্চার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। গতকালের দুইটা ঘটনা কিন্তু তারা জড়িত ছিল। ইতোপূর্বে কুয়েটের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পেছনেও প্রত্যক্ষ ইন্ধন ছিল।”
মুন্না বলেন, “গত সাপ্তাহে কুমিল্লায় মব তৈরি করে একই পরিবারের তিনজনকে নৃশংস কায়দায় হত্যা করা হয়েছে। ইতোপূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে তোফাজ্জল নামের এক যুবককে এবং পরবর্তীতে ছাত্রদল নেতা সাম্যকে বর্বর কায়দায় হত্যা করা হয়।“প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা পারভেজকে প্রকাশ্য দিবালোকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামধারী স্থানীয় সন্ত্রাসীরা।”
বিএনপির সহযোগী সংগঠন যুবদল সভাপতি মুন্না বলেন, “আগামী জাতীয় নির্বাচনের সমর্থনসহ নানা বিষয়ে তরুণদের মাঝে পরিচালিত এক জরিপের ফলাফল গত সপ্তাহে প্রকাশিত হয়েছে। এখানে দেখা গেছে, যারা নিজেদের তারুণ্যের একমাত্র স্টেকহোল্ডার হিসেবে দাবি করেন, জরিপে তাদের সেই দাবি বুমেরাং হয়েছে।“এদেশের তরুণেরা বরং বহু লড়াই ও সংগ্রামের পরীক্ষিত বাংলাদেশপন্থী শক্তি বিএনপিতেই তাদের আস্থা ও বিশ্বাস রাখে বলে প্রতিভাত হয়েছে। আগামীতে বিএনপিকেই এদেশের অধিকাংশ তরুণেরা ক্ষমতায় দেখতে চায় বলে জরিপের ফলাফলে উঠে এসেছে।”এরপরই একটি ‘গুপ্ত’ সংগঠন ও তাদের দিকনির্দেশনায় পরিচালিত একটি ‘আনাড়ি’ দলের নেতাকর্মীরা ‘উদ্ভ্রান্ত’ হয়ে পড়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তারা নতুন করে নানা ষড়যন্ত্র ও ফন্দিফিকিরে লিপ্ত হয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনে স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এসএম জিলানী, সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি রেজাউল করীম পল, ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির।

আরও পড়ুন