৭ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ব্যর্থতা ফেল নয়, অভিজ্ঞতা

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী : মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে বিজয়ী হওয়ার জন্য,পরাজিত হওয়ার জন্য নেয়। দুনিয়াতে যারা বিজয়ী হয়েছেন তারা প্রতিযোগিতা করে বড় হয়েছেন। কত বড় যুদ্ধ করে মানুষ দুনিয়াতে এসেছে তা অধিকাংশ মানুষের জানা নেই।একটা শিশু পিতার দেহ হতে ৪০/৫০ কোটি শুক্রাণু মাতৃগর্ভের একটি ডিম্বানুর সাথে মিলিত হওয়ার প্রচণ্ড প্রতিযোগিতায় সকল শুক্রানুকে পরাজিত করে একটি মাত্র শুক্রানু ডিম্বানুর সাথে মিলিত হয়ে মানুষ রূপে পৃথিবীতে আসে। সংগ্রামের মাধ্যমে যে মানব জীবনের সৃষ্টি সে মানব কোনদিন পরাজিত হতে পারে না।
ক্ষমতা কোথায়? ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, এম পি, সচিবের চেয়ারে নয়, প্রকৃত ক্ষমতা থাকে মাথায়। মাথার ক্ষমতা ব্যবহার করে মানুষ বিশ্বজয় করেছে। মানব সভ্যতার সবচেয়ে ব্যর্থতা কী? বড় ব্যর্থতা হলো মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তিকে ব্যবহার করতে না পারা। যে মানুষ পৃথিবীটাকে পাল্টে দিতে পারে, সে মানুষ পশুর মত শুধু নিজকে চালাবে কেন! পশুর ক্ষমতায় বন্দী রাখতে মহান আল্লাহ পাক মানুষকে দুনিয়াতে প্রেরণ করেননি। মানুষ ধ্বংসের মাঝে সৃস্টি করতে পারে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন,’ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর প্রলয় নতুন সৃজন বেদন, আসছে নবীন জীবন হারা অসুন্দরের করতে সৃজন’।ধ্বংসের মাঝে সৃষ্টির প্রেরণা থাকলে মানুষকে কেউ পরাজিত করতে পারে না। মানুষের শক্তি ধ্বংস হওয়ার নয়। রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রশক্তির পরিবর্তে আত্মশক্তি ও সমাজ শক্তির জাগরণের কথা তুলে ধরেছেন।মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। সে মানুষের অসহায়ত্ব দেখে আমি বিস্মিত হই। কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর বিদ্রোহী কবিতায় মানুষের শক্তি প্রকাশ করতে উচ্চারণ করেছেন, আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস / আমি আপনাকে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ’ কবি আত্মশক্তির বিকাশের কথা বলার কারণে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর বৃটিশ সরকার তাঁর একাধিক বই বাজেয়াপ্ত করে এবং তাঁকে কারাদণ্ড প্রদান করে। কিন্তু তাঁর শক্তির বিনাশ ঘটাতে পারেনি এবং শক্তির অনেক প্রসার ঘটেছে।
সাধারণ মানুষের সাথে অসাধারণ মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধির মধ্যে বড় কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্য হলো আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়সংকল্পের। সাধারণ মানুষের আত্মবিশ্বাস সাধারণ আর অসাধারণ মানুষে আত্মবিশ্বাস অনেক বড়। আত্মবিশ্বাসী মানুষ ব্যর্থ হতে পারে না। আত্মবিশ্বাসী মানুষ বহু ক্ষেত্রে ব্যর্থ হন কিন্তু তাদেরকে ব্যর্থ বলা যাবে না। তাদের প্রতিটা চেষ্টাই এক একটা পরীক্ষা। পরীক্ষা সব সময় ফল দেয় না, অভিজ্ঞাতাদেয়। সাফল্যের চেয়ে অভিজ্ঞতার মূল্য কম নয়। সফল মানুষ সফলতা আর ব্যর্থতার মধ্যদিয়ে পথ চলে। নিষ্ক্রিয় মানুষের চেয়ে সক্রিয় ব্যর্থ মানুষের মূল্য অনেক বেশি। প্রতিটি মানুষের মাথায় আছে দশ হাজার কোটি নিউরন। এই নিউরনের দশ ভাগ ব্যবহার করতে পারলে কোন মানুষই ব্যর্থ হতে পারে না। মস্তিষ্কের ক্ষমতা ব্যবহার করে একটি মানুষ একটি জাতিকে পরিবর্তন করে দিতে পারে,সৃষ্টি করতে পারে নতুন ইতিহাস। মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতা বিশাল কিন্তু তার বিশালতা দেখতে পাই না আমরা,কারণ আত্মবিশ্বাসের অভাবে। একজন মানুষ কী কী করতে পারে তার সীমা পরিসীমা নেই। একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ সবকিছু হারালেও স্বপ্ন ও সাহস নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরও আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রতিরোধ করে সাফল্য ছিনিয়ে আনতে পারেন।
ইন্দোনেশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট বিপ্লবী সুকর্ণ বলেছিলেন, আমাকে দশ জন আত্মবিশ্বাসী যুবক দাও, আমি সারা বিশ্ব তোলপাড় করে দিবো’। আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি ডা. মাহাথির মোহাম্মদ বলেছেন, আমি দশ জন আত্মবিশ্বাসী যুবক পেলে আমি মালয়ীদের সাথে নিয়ে বিশ্ব জয় করতে পারবো’। সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা লি কোয়ান ইউ বলেছিলেন, আমি যখন সিঙ্গাপুর স্বাধীন করি তখন এগারো জন আত্মবিশ্বাসী সৎ লোক খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। এগারো জন আত্মবিশ্বাসী সৎ লোক নিয়ে আমি মন্ত্রী পরিষদ গঠন করি। বাকীদের সাথে আমি স্বৈরাচারী আচরণ করি। সেদিন অসৎ, সন্ত্রাসী, জলদস্যু, চোরদের সাথে যদি স্বৈরাচারী আচরণ না করতাম তাহলে তোমরা আজ এই আধুনিক সিঙ্গাপুরের মুখ দেখতে না। দেশদ্রোহী অপরাধীর সাথে গণতান্ত্রিক আচরণ চলে না। ফার্সী ভাষার সেরা কবি হযরত শেখ সাদী (রহ) বলেছেন, বাঘের প্রতি করুণা করা মানে ছাগলের প্রতি জুলুম করার নামান্তর। যে বাঘ শত শত নিরীহ প্রাণী হত্যা করে সে বাঘের প্রতি করুণা চলে না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গণতান্ত্রিক নাগরিক গড়ে তুলতে হয়।না হয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
প্রকৃতপক্ষে মাহাথির সুকর্ণ, লি কোয়ানের মত দুই একজন মানুষ বিশ্ব পরিবর্তন করে দিতে পারে।বড় বড় কাজের জন্য বহু মানুষের প্রয়োজন হয় না।একজন নেতা শুধু নিজে জাগে না, পুরো জাতিকে জাগিয়ে তুলতে পারেন। নেতাদের বড় কাজ স্বপ্ন দেখানো। আমি যদি একা কাজ করি তাহলে আমি একজন কর্মী, যদি আমি মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়ে জাগিয়ে তুলতে পারি তাহলে আমার আছে নেতা হওয়ার যোগ্যতা আছে।একা কাজ করার চেয়ে ১০ জন মানুষকে জাগিয়ে কাজ করাতে পারলে ১০ গুণ বেশি কাজ হবে।তার জন্য স্বপ্ন দেখানো বড় কাজ।সমাজে অনেক বড় বড় শিক্ষিত লোক দেখি যারা আত্মবিশ্বাসের অভাবে জীবনকে কাজে লাগাতে পারেনি। জীবনে সফলতা আসেনি।আমরা আমাদের সন্তানদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পপতি বানাতে চাই কিন্তু আত্মবিশ্বাসী মানুষ বানাতে চাই না। তাই আমাদের সন্তানরা ছোট বেলায় যে স্বপ্ন দেখে সে স্বপ্নকে সার্থক করতে পারেন না।সকলে মুক্তি চায় কিন্তু পথ খুঁজে পায় না।সেবা দিতে চায় কিন্তু সেবা দানের যোগ্য হয় না। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘ফাস্ট ডিজার্ভ দ্যান ডিজায়ার’ আগে যোগ্য হও, পরে ইচ্ছা পোষণ করো। বড় কিছু হতে চাইলে শুধু ইচ্ছা করলে বড় হবে না, বড় তো সবাই হতে চায় কিন্তু পারে না, কারণ বড় হওয়ার যোগ্যতা লাগে। যোগ্যতা অর্জনের জন্য লাগে আত্মবিশ্বাস।
জর্জ বার্নার্ড শ’ প্রথম জীবনে বড় হতাশাবাদী ছিলেন। তিনি সাধনার মাধ্যমে হতাশাকে বিদায় জানিয়ে বিশ্বখ্যাত লেখক ও নাট্যকার হয়েছিলেন। কলম্বাস মাত্র কয়েকজন বন্ধু নিয়ে ক্ষুদ্র একটি জাহাজে করে আমেরিকাসহ কয়েকটি রাষ্ট্র আবিষ্কার করেন। পথের শত বাধ্য তিনি আত্মবিশ্বাস নিয়ে অতিক্রম করেছিলেন। মহাকবি আবুল কাশেম ফেরদৌসী দীর্ঘ ত্রিশ বছর সাধনা করে রচনা করেন তাঁর অমর মহাকাব্য ‘শাহনামা’।আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না।ছিলেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান।দরিদ্রতাকে হার মানিয়ে তিনি সংগ্রহ করেন দুই হাজার প্রাচীন পুঁথি। এই পুঁথি সাহিত্যের কারণে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চার শত বছরের অজনা অধ্যায় উদ্‌ঘাটিত হয়। মানুষের অসম্ভব শক্তি। মানুষ পারে না এমন কিছু মানুষের অভিধানে নেই। বিজ্ঞানীরা বিদ্যুৎ আবিষ্কার করে দূর করেন অন্ধকার, বিমান আবিষ্কার করে বিজয় করেন আকাশ, রকেট আবিষ্কার করে জয় করেন চন্দ্র, এখন পৃথিবীর বাইরে মানুষের বাসযোগ্য আরেকটি গ্রহ জয় করতে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা উন্নয়ন বুঝি কিন্তু উন্নতি বুঝি না।নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘মানব উন্নয়ন উন্নতির সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ার’। অর্থাৎ তিনি মানুষের শক্তির বিকাশের কথা বলেছেন।
মধ্যযুগের ছিল সপ্তম আশ্চার্য, আধুনিক যুগে চারদিকে হাজার হাজার আশ্চার্য এবং বিস্ময়। আশ্চার্যগুলোর সৃষ্টি হয়েছে কঠোর সাধনা আর আত্মবিশ্বাসের কারণে।বিজ্ঞানীদের যেসব আবিষ্কারগুলো আমরা ভোগ করছি এ সব বিজ্ঞানীরা কিন্তু ভোগী ছিলেন না ছিলেন সাধক।কল্যাণমূলক আবিষ্কারগুলো তাঁরা নিজের জন্য,নিজের ব্যবসায়ী লাভের জন্য করেননি,মানুষের জন্য করেছেন।বিশ্বাসীদের সাধনার কারণে এই পৃথিবী নামক গ্রহটি পরিবর্তন হয়ে যায়।এক সময় দুনিয়ার সমস্ত মানুষ বিশ্বাস করতো, পানির চেয়ে ভারী বস্তু ভাসতে পারবে না, একজন এসে বিশ্বাস করলো, সম্ভব। সে জাহাজ আবিষ্কার করেন। সব মানুষ বিশ্বাস করতো বাতাসের চেয়ে ভারী বস্তু উড়তে পারবে না, একজন এসে বিশ্বাস করলেন সম্ভব।সে বিশ্বাসী আবিষ্কার করলো বিমান।সকল মানুষ এক সময় বিশ্বাস করতো তারের মাধ্যমে কথা বলা সম্ভব নয়, এক বিশ্বাসী বললে, সম্ভব,সে টেলিফোন আবিষ্কার করলেন।মানুষ এক সময় বিশ্বাস করতো তার ছাড়া কথা বলা সম্ভ নয়, এক বিশ্বাসী বিজ্ঞানী এসে ঘোষণা করলেন, সম্ভব, সে বেতার আবিষ্কার করলেন। মানুষ বিম্বাস করতো বেতার দ্বারা ছবি দেখা সম্ভব নয়,এক বিজ্ঞানী বললেন, সম্ভব।সে টেলিভিশন আবিষ্কার করেন।এই নতুন বিশ্বের পরিবর্তনকারী সব জ্ঞান বিজ্ঞানীরা সবাই ছিলেন বিশ্বাসী,আর আত্মবিশ্বাসী।বিশ্বাসীরাই বিজয়ী,অবিশ্বাসীরা পরাজিত।
লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিক

আরও পড়ুন