১৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বাংলাদেশিসহ ৯০ লাখ মানুষ যুক্তরাজ্যে নাগরিকত্ব হারাতে পারে

অনলাইন ডেস্ক : একটি নতুন প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব বাতিলের ‘চরম ও গোপন’ ক্ষমতা লাখো ব্রিটিশ মুসলিম নাগরিককে গুরুতর ঝুঁকিতে ফেলছে। যুক্তরাজ্যের দুই স্বনামধন্য মানবাধিকার ও নীতি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রানিমিড ট্রাস্ট এবং রিপ্রিভ গত বৃহস্পতিবার এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যে প্রায় ৯ মিলিয়ন (৯০ লাখ) মানুষ, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৩ শতাংশ দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ক্ষমতায় আইনগতভাবেই নাগরিকত্ব হারাতে পারেন। অধিকারকর্মীরা সতর্ক করে বলেছেন, এই ক্ষমতা দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার সঙ্গে সম্পর্কিত নাগরিকদের বিপদে ফেলবে।উভয় সংস্থাই সতর্ক করে দিয়েছে, ‘নাগরিকত্ব বাতিলের ব্যবস্থা’ এখন মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি পদ্ধতিগত হুমকি, যা ক্যারিবীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিকদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের উদাহরণ হিসেবে পরিচিত ‘উইন্ডরাশ কেলেঙ্কারি’র সঙ্গে তুলনা করা যায়।
বর্তমান আইন অনুসারে, ব্রিটিশ নাগরিকরা তাদের জাতীয়তা হারাতে পারেন, যদি সরকার বিশ্বাস করে যে, যদি সরকার মনে করে যে তিনি অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য। এমনকি যদি তারা কখনো সেই দেশে বাস নাও করে থাকে বা ওই দেশের নাগরিক মনে না করে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, সোমালিয়া, নাইজেরিয়া, উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রয়েছে।যাদের মধ্যে যুক্তরাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য।
অধিকারকর্মীরা বলছেন, এর ফলে নাগরিকত্বের একটি বর্ণবাদী শ্রেণিবিন্যাস তৈরি হয়েছে। যেখানে মুসলিমদের যুক্তরাজ্যে থাকার অধিকার শর্তসাপেক্ষ হয়ে পড়ছে, যা শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। রিপ্রিভের মায়া ফোয়া মিডল ইস্ট আইকে বলেছেন, ‘আগের সরকার রাজনৈতিক সুবিধার জন্য মানব পাচারের শিকার ব্রিটিশ নাগরিকদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছিল।আর বর্তমান সরকার এ চরম ও গোপন ক্ষমতা আরো বাড়িয়েছে।’ফোয়া বলেন, ‘যে ৯০ লাখ মানুষের অধিকার পরবর্তী স্বরাষ্ট্রসচিব কেড়ে নিতে পারেন, তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, বিশেষ করে যদি পুরোপুরি কর্তৃত্ববাদী কোনো সরকার সামনে ক্ষমতায় আসে।’
রানিমেড ট্রাস্ট পরিচালনাকারী শাবনা বেগমও ফোয়ার মতোই উদ্বেগের কথা জানান, স্বরাষ্ট্র দপ্তরের বিবেচনার ভিত্তিতে নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার একটি ‘ভয়াবহ ধারা’ চলছে এবং এটি ব্রিটেনের মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর অসমভাবে প্রভাব ফেলেছে। বেগম এমইইকে বলেন, ‘উইন্ডরাশ কেলেঙ্কারির জন্য দায়ী আইনগুলোর মতোই এখানে কার্যকর কোনো নজরদারি ব্যবস্থা নেই, যা এ ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহার ঠেকাতে পারে।’ তিনি আরো বলেন, ‘নাগরিকত্ব একটি অধিকার, বিশেষাধিকার নয়।তবুও পরপর সরকারগুলো নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে দ্বি-স্তরীয় পদ্ধতির দিকে এগিয়ে চলেছে। একটি বিপজ্জনক নজির স্থাপন করছে যে, ‘ভালো’ বা ‘খারাপ’ আচরণের ভিত্তিতে কারো নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া যেতে পারে, আপনার পরিবার এই দেশে কত প্রজন্ম ধরে বাস করেছে তা বিবেচনায় আনা হবে না।’
ঝুঁকিতে প্রতি পাঁচজনে তিনজন বর্ণের মানুষ
রিপ্রিভ এবং রানিমেডের বিশ্লেষণে দেখা গেছে: প্রতি পাঁচজনে তিনজন বর্ণের মানুষের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হতে পারে। প্রতি ২০ জন শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশের মধ্যে মাত্র একজন একই ঝুঁকির সম্মুখীন।ভারতের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহ্যবাহী ব্যক্তিরা (৯,৮৪,০০০ জন), পাকিস্তান (৬,৭৯,০০০) এবং বাংলাদেশ (ঝুঁকিতে থাকা ৩.৩ মিলিয়ন এশীয় ব্রিটিশদের অংশ) সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছেন। তবে বাস্তবে যাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে, তাদের অধিকাংশই দক্ষিণ এশীয়, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার বংশোদ্ভূত মুসলিম।উভয় সংস্থাই বলেছে, জাতিগত বৈষম্য উইন্ডরাশ কেলেঙ্কারির জন্মদানকারী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার প্রতিফলন। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় অশ্বেতাঙ্গ মানুষ নাগরিকত্ব হারানোর ১২ গুণ বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, কীভাবে দুই দশকের সন্ত্রাসবিরোধী আইন (একসময় ব্যতিক্রমী যুদ্ধকালীন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো) নাগরিকত্ব বাতিলে রূপান্তরিত হয়েছে।
২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে ২০০ জনের বেশি মানুষের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে। সরকার বলেছে, এটি জনস্বার্থের জন্য করা হয়েছে। তবে যাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই মুসলিম। ২০২২ সালে সরকার এমন ক্ষমতা পায়, যার মাধ্যমে কাউকে আগেই না জানিয়ে তার নাগরিকত্ব বাতিল করা যায়।২০২৫ সালের নতুন এক আইনে বলা হয়েছে, আদালত যদি সিদ্ধান্ত দেয়, নাগরিকত্ব বাতিল করা বেআইনি ছিল, তবুও সরকার আপিল করলে সেই আপিল শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার নাগরিকত্ব ফেরত পাবেন না। এই প্রক্রিয়া অনেক সময় বছরের পর বছর চলতে পারে।সবচেয়ে আলোচিত মামলাটি শামীমা বেগমের। যুক্তরাজ্যে জন্ম নেওয়া এই কিশোরীর নাগরিকত্ব বাতিল করা হয় এই দাবি করে যে, তিনি নাকি বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশ সরকার সে দাবি অস্বীকার করেছে। শামিমা কিশোর বয়সে আইএসে যোগ দিতে যুক্তরাজ্য ছেড়েছিলেন। পরে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তার আবেদন খারিজ করে দেয় যুক্তরাজ্য।
যেহেতু নাগরিকত্ব বাতিলের ক্ষমতা মূলত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত, তাই মুসলিম সংগঠনগুলো আশঙ্কা করছে—বর্ধমান জাতীয়তাবাদী রাজনীতি এই ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহার ঘটাতে পারে।
এদিকে এ প্রতিবেদন এমন এক সময়ে প্রকাশিত হলো, যখন কনজারভেটিভ ও রিফর্ম ইউকে দলের রাজনীতিকেরা আরও কঠোর ভাষায় কথা বলছেন। দুই দলই এমন পরিকল্পনার কথা বলছে, যাতে যুক্তরাজ্যে আইনিভাবে বসবাসকারী লাখো মানুষকে দেশ ছাড়া করা হতে পারে।সূত্র : মিডিল ইস্ট আই

আরও পড়ুন