১৭ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

তরতর করে নামছে এনসিপির ইমেজ 

অনলাইন ডেস্ক: ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের এক দফা দাবিতে ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক দফার ঘোষণা দেন মো. নাহিদ ইসলাম। অভ্যুত্থানের সেই উত্তাল সময়ে নাহিদ ইসলামসহ ছাত্রনেতাদের ডাকে সারা দেশের রাজপথে নেমে আসেন জনগণ।৫ আগস্ট পতন ঘটে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের। অভ্যুত্থানের পর বন্যাসহ একাধিক ঘটনায়ও তাদের ডাকে বিপুল সাড়া দেখা যায়।
এই জনপ্রিয়তাকে সামনে রেখেই চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের সংগঠকরা মিলে গঠন করেন জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। অভ্যুত্থানের বছর ঘুরে এসে দেখা যাচ্ছে, তাদের জনপ্রিয়তায় অনেকটাই ভাটা পড়েছে। এনসিপি নিয়ে আশা-আকাঙ্ক্ষাও ফিকে হতে শুরু করেছে। এনসিপির কেউ কেউ জড়িয়েছেন অনৈতিক কাজে। অনেকেই ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যের বিভাজন ঘটানো বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে হারিয়েছেন জনপ্রিয়তা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই অভ্যুত্থানে নাহিদ-সারজিস-হাসনাতদের দেখে মানুষের মধ্যে আশা জেগেছিল। তারা একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বপ্ন উবে যেতে শুরু করেছে। মানুষের আকাঙ্ক্ষার ইতিবাচক রূপান্তর ঘটাতে পারছে না এনসিপি। পুরনো বন্দোবস্তের বিলোপ চেয়ে রাজনীতিতে নামা এনসিপির অনেকেই পুরনো আদলে শোডাউন করছেন, মহড়া দিচ্ছেন, করছেন তদবির, দেন-দরবার। যদিও সম্প্রতি ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচি’ দিয়ে মানুষের কাছাকাছি গিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা। তবে এই পদযাত্রায় নিজেদের ইমেজ কতটা পুনরুদ্ধার হয়েছে, তা নির্বাচনের মধ্য দিয়েই প্রতিফলিত হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এনসিপির নেতাদের ঘিরে অভিযোগের তোড়:
দল গঠনের শুরু থেকেই বিতর্কে জড়ান এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীর। তার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক নিয়োগে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পাঠ্যবই ছাপার কাগজে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। যদিও তিনি এই অভিযোগ নাকচ করেন। তবে তানভীরকে দল থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি নৈতিক স্খলনের অভিযোগ উঠেছে এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম-আহবায়ক সরোয়ার তুষারের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক সতীর্থের সঙ্গে তার অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ ওঠার পর দলটি থেকে তাকে কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ দেয়। এরপর থেকে সাংগঠনিক কার্যক্রমে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় এই নেতা। তবে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে সক্রিয় দেখা যায়।
এ বছরের ২১ মে বিশৃঙ্খলা তৈরির অপরাধে আটক হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন নেতা। তখন ধানমন্ডি থানায় দেন-দরবার করে তাদের ছাড়িয়ে আনেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ। এ নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা তৈরি হয়। পরে ভুল স্বীকার করে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন হান্নান মাসউদ।
আলোচনা তৈরি হয় এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমকে নিয়েও। তিনি শতাধিক গাড়ি নিয়ে নিজ এলাকায় শোডাউন দেওয়ার পর তার আর্থিক উৎস নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ ঘটনায় হতাশ হন তরুণদের অনেকেও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষার্থী কীভাবে শতাধিক গাড়ির শোডাউন দিয়েছেন, তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয় সবার মনে। এ ঘটনায় নিজ দলের নেত্রী ডা. তাসনিম জারাও সারজিস আলম থেকে জনসম্মুখে জবাবদিহিতা চান। যদিও সারজিস তার পারিবারিক সচ্ছলতার বিষয় তুলে ধরে ব্যাখ্যা দেন, কিন্তু পুরোনো রাজনৈতিক আদলে তার এই শোডাউন আশাবাদী তরুণদের রুষ্ট করে।
এসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহর বিভিন্ন বক্তব্যও দলটিকে নানাভাবে আলোচনায় নিয়ে এসেছে। তিনি আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন চেষ্টার চক্রান্তে সেনাবাহিনীর নাম জড়িয়ে বক্তব্য দিলে এ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। এছাড়া সাংবাদিকদের হুমকি দিয়ে তার আরেক বক্তব্যও বিতর্কের জন্ম দেয়।
এনসিপির নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়েছে দলের মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বক্তব্যে। ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যে বিভাজন ঘটানোর বক্তব্যও বেশি এসেছে তার মুখ দিয়ে। আগের নানান বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় তিনি গত ১৯ জুলাই এনসিপির পদযাত্রায় কক্সবাজারে গিয়ে এক পথসভায় বলেন, ভারতের শিলং থেকে কক্সবাজারে ‘নব্য গডফাদার’ এসেছে।
গুম হয়ে শিলং থাকতে বাধ্য হওয়া বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদকে নিয়ে তার ওই বক্তব্যে কক্সবাজার ছাড়িয়ে গোটা দেশে আলোচনার ঝড় বয়ে যায়। এর জেরে কক্সবাজারে এনসিপির পথসভায় হামলা-ভাঙচুরও হয়। এমনকি পরবর্তী কয়েকটি জেলায়ও এনসিপির পদযাত্রা ক্ষোভের মুখে পড়ে।
এরপর গত ৫ আগস্ট জুলাই ঘোষণাপত্রের দিন কক্সবাজারে ঘুরতে যান এনসিপির শীর্ষ ৫ নেতা। এদের মধ্যে ছিলেন এনসিপির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. তাসনিম জারা ও যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ। জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির দিনেই তারা কেন অবকাশ যাপনের জন্য বেচে নেন, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন অনেকেই। যদিও তারা ব্যক্তিগত সফর বলে গণমাধ্যমকে জানান। তবে এনসিপির পক্ষ থেকে এজন্য তাদের শোকজ করা হয়।
সবশেষ আবারও বিতর্ক উসকে দেন নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। ১২ আগস্ট ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না। যদিও ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে ভাষণে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নির্বাচন আয়োজনে কার্যক্রমও শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। এই প্রস্তুতির প্রেক্ষাপটে নাসীরুদ্দীনের এমন মন্তব্য নিয়ে নানা আলোচনা তৈরি করে। অনেকে অভিমত দেন, এই বক্তব্য নির্বাচনের পেছানোর ইঙ্গিত বহন করে।
দল ছাড়ছেন নেতারা, জরিপের ফলও ভালো নয়:
এনসিপির নেতাদের এসব কার্যকলাপের কারণে প্রায়ই দলটির বিভিন্ন পর্যায় থেকে পদত্যাগের খবর আসছে। একটি গণমাধ্যমের খবর অনুসারে, গত দুই মাসে এনসিপি থেকে প্রায় ২৫ নেতা-কর্মী পদত্যাগ করেছেন। এ সময়ে একাধিক কমিটি স্থগিতও করা হয়েছে।
১ জুলাই থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভার্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) পরিচালিত এক জরিপ অনুসারে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে এনসিপি খুব ‍সুবিধা করতে পারবে না।
জরিপ বলছে, এতে অংশ নেওয়া ৫ হাজার ৪৮৯ জনের মধ্যে মাত্র ২ দশমিক ৮ শতাংশ আগামী নির্বাচনে জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) ভোট দিতে চেয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপিকে ভোট দিতে চেয়েছেন ১২ শতাংশ উত্তরদাতা, জামায়াত ইসলামীকে ভোট দিতে চেয়েছেন ১০ দশমিক ৪ শতাংশ উত্তরদাতা, আওয়ামী লীগকে (যদি ভোটে অংশ নিতে পারে) ভোট দিতে চেয়েছেন ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ উত্তরদাতা কোনো সিদ্ধান্ত নেননি বলে জানিয়েছেন।
পর্যবেক্ষকরা কী বলছেন:
বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যের কারণে এনসিপির জনপ্রিয়তায় ব্যাপক ধস নেমেছে জানিয়ে জুনে এক বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অধ্যাপক সাইফুল আলম বলেন, গত সাড়ে ৯ মাসে ৮০-৯০ শতাংশ তরুণরা হতাশ। এনসিপি তরুণদের দল। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই, তাদের যে জনপ্রিয়তা ছিল, তাতে ব্যাপক ধস নেমেছে। এটা হয়তো তারাও বুঝেছে।
তিনি বলেন, শ্রীলংকার সবাই মিলে আন্দোলন করে রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়েছেন। তারপর তাদের যার যে কাজ, সেখানে ফিরে গেছেন। শিক্ষার্থীদের কাজ ক্লাসরুমে যাওয়া, ব্যবসায়ীর কাজ ব্যবসা করা, সাংবাদিকের সাংবাদিকতা করা। অন্যের কাজে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান মনে করছেন, এখনই এনসিপিকে মূল্যায়ন করার মতো সময় হয়নি। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তাদের প্রতি জনগণের মনোভাব বোঝা যাবে।
তিনি বলেন, জাতীয় নাগরিক পার্টি নতুন ধারার রাজনীতির যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা রাখতে পারলে তাদের রাজনীতির জন্য ভালো। তবে তারা এখনো কোনো পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যায়নি। যদি কোনো নির্বাচন হয়, তাহলে বোঝা যাবে তারা নাগরিকদের মধ্যে কতটা গুরুত্ব পাবে।
অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, তারা যত বেশি তারা দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি মুক্ত থাকতে পারবে, তত তাদের রাজনীতি টিকে থাকবে। যতটা নাগরিকের কাছাকাছি যেতে পারবে, ততটাই তারা মূল্যায়িত হবে। এক সমাবেশে নানা ধরনের মানুষ যেতে পারে। তবে তাদের অবস্থান নির্ধারিত হবে, আগামী নির্বাচনে তারা কতটা ভোট পাবে।
সম্প্রতি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নেত্র নিউজের এডিটর ইন চিফ তাসনিম খলিল বলেন, এনসিপির মধ্যে কিছু নেতা আছে, যারা এনসিপির জন্য কাজ করে না। এরা আবার জনপ্রিয়। আমি নাহিদ ইসলামকে নিয়ে চিন্তিত, আদৌ দলে তার নিয়ন্ত্রণ আছে কি না।
তিনি বলেন, নাহিদ ইসলামের পরের পর্যায়ের দুই নেতা গণঅভ্যুত্থান চলাকালে ডিজিএফআইয়ের ডেড কমান্ডের আশ্রয়ে তাদের মেসে ছিল, যারা কারফিউ পাস নিয়ে পুরো ঢাকা শহর ঘুরেছে, তারাই এখন সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা। তারা এনসিপির স্বার্থে কাজ করে না।

 

আরও পড়ুন