মোহাম্মদ জাহেদ উল্লাহ চৌধুরী: রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে শক্তিশালী ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পর চট্টগ্রামে নতুন আতংক বিরাজ করছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে নগরীর ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ভবন ধসে পড়তে পারে এবং প্রাণহানি লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে আইনবিধির তোয়াক্কা না করে একের পর এক বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে চট্টগ্রামে। নকশা অনুমোদনের পরের ধাপগুলো মানা হয়নি, গুণগত মানহীন উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের চারদিকে অবস্থানরত সক্রিয় টেকটনিক প্লেটগুলো অস্বাভাবিক গতিশীল। চট্টগ্রাম নগরীর ভূগর্ভেও একটি মাইনর টেকটনিক প্লেট সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। প্লেটগুলোর ধারাবাহিক নড়াচড়ার কারণে ২০২১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দেশে ২১২ বার ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। তারা বলেছেন, নকশা না মেনে ভবন করা, গুণগত মানসম্পন্ন নির্মাণ উপকরণসামগ্রী ব্যবহার না করায় বেশি ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ভূমিকম্প হলে উদ্ধার তৎপরতা চালানো ও পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর যথাযথ প্রস্তুতি ও সুযোগ-সুবিধাও নেই।
এদিকে ভূমিকম্পে চট্টগ্রাম মহানগরের মনসুরাবাদ এলাকার ‘স্টার ভবন’ নামের একটি ছয়তলা ভবন হেলে পড়েছে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। গত শুক্রবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ওই ভবন পরিদর্শন করেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং ডবলমুরিং থানার পুলিশ সদস্যরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভবনের ছাদ পাশের আরেক ভবনের দিকে কিছুটা হেলে পড়েছে। পাশের ভবনের মালিক আবদুল্লাহ বিন আশরাফ বলেন, প্রায় পাঁচ বছর আগে ভবনটি কিছুটা হেলে পড়েছিল। এবার ভূমিকম্পের পর আরও হেলেছে। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস জানান, চট্টগ্রাম নগরে ইমারত বিধিমালা না মেনে অনেক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, এ কথা সত্য। ফলে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে নগরের ৭০ শতাংশ ভবন সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে ২ লাখ ৬৭ হাজার ভবন।ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে ২ লাখ ৬৭ হাজার ভবন। তিনি বলেন, বর্তমানে অনুমোদন পাওয়া ভবনগুলোর ক্ষেত্রে নিয়মিত তদারক করা হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, এবার ভূমিকম্পে চট্টগ্রামে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে ভূমিকম্পে চট্টগ্রামে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেনি। তবে ২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যা ৭টা ৫৫ মিনিটে ৬ দশমিক ৯৯ মাত্রার ভূমিকম্পে নগরে ১২টি ভবন হেলে পড়েছিল। এর আগে ১৯৯৭ সালের ২১ নভেম্বর ৬ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পে চট্টগ্রাম নগরে পাঁচতলা ভবন ধসে হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল।
চুয়েটের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চট্টগ্রামের বহু ভবনের বয়স ৫০ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে। এগুলোর প্রায় ৭৫ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ। নতুন অনেক ভবনও ভূমিকম্প প্রতিরোধী নকশা ছাড়া নির্মাণ করা হচ্ছে। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) জানায়, নগরীতে বর্তমানে ৪ লাখ ১ হাজার ৭২১টি বহুতল ভবন রয়েছে। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৪৮০টি ভবনের উচ্চতা ৬ থেকে ১০ তলা, আর ৪৮৪টি ভবন ১০ তলার বেশি। অনেক ভবনে বিল্ডিং কোড অনুসরণ করা হয়নি। উপকূলীয় এলাকা হওয়ায় নির্মাণসামগ্রী দ্রুত ক্ষয়প্রবণ হওয়া এবং সংকীর্ণ সড়কগুলো দুর্ঘটনার সময় উদ্ধারকাজে বড় বাধা হতে পারে।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আনোয়ার হোসেন বলেন, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার এবং সাগরের নিকটে হওয়ায় নির্মাণসামগ্রীর কিউরিং প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় ভবনগুলো আরও দুর্বল হয়ে পড়ে।
জানা গেছে, গত চার বছরে দেশের ভেতরে ৩৭টি ভূকম্পন ঘটলেও বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি। তবে শুক্রবারের ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প রাজধানী ও চট্টগ্রাম-দুই জায়গাতেই বাস্তব ঝুঁকি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে।চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মনজারে খোরশেদ আলম বলেন, যেসব ভবন রেট্রোফিটিং করে ঝুঁকিমুক্ত করা সম্ভব, সেগুলো করতে হবে। আর যেগুলো টেকনিক্যালি ঝুঁকিমুক্ত করা সম্ভব নয়, সেগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। উদ্ধারকারী বাহিনীর গাড়ি চলাচল নিশ্চিত করতে সংকীর্ণ সড়কগুলো প্রশস্ত করতে হবে। পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উচিত নিয়মিত মানুষকে সতর্ক করা।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা, ২০০৮ অনুযায়ী, ভবন নির্মাণের সময় আটটি স্তরে অনুমোদন নিতে হয় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। এগুলো হলো ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র, নির্মাণ অনুমোদন, নির্মাণকাজ শুরু অবহিতকরণ ও কারিগরি ব্যক্তিদের সম্মতিপত্র, ভবনের ভিত্তি স্তম্ভ পর্যন্ত কাজ সম্পর্কে কারিগরি ব্যক্তিদের প্রতিবেদন, ভবনের নির্মাণকাজ সমাপ্তি অবহিতকরণপত্র, কারিগরি ব্যক্তিদের প্রত্যয়নপত্র, ব্যবহার সনদ ও পাঁচ বছর পর ব্যবহার সনদ নবায়ন। চট্টগ্রামে গড়ে ওঠা অধিকাংশ ভবনের নকশা অনুমোদন নেওয়া হয়েছে ঠিকই, তবে অনুমোদনের পরের ধাপগুলো অনুসরণ করা হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রামের বেশির ভাগ ভবনে ভূমিকম্প-প্রতিরোধী কোনো ব্যবস্থা নেই। চউক কোনো ধরনের তদারক করেনি। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে এগুলোর বেশির ভাগ পুরোপুরি ধসে পড়বে, কিছু আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে প্রচুর মানুষ হতাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।





