নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানী ঢাকার ১৭০টি ট্যানারি থাকলেও চট্টগ্রামে রয়েছে মাত্র একটি। চট্টগ্রামে আরও কয়েকটি ট্যানারি থাকলে চামড়া বেচাকেনায় অনেক সুবিধা হতো। ফলে বরাবরের মতো বিপুল পরিমাণ চামড়া সংগ্রহের সুযোগ থাকলেও সুষ্ঠু প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাতকরণ নিয়ে দেখা দেয় গভীর অনিশ্চয়তা। এ পরিস্থিতি কেবল চট্টগ্রামের আড়তদারদের নয়, সামগ্রিকভাবে দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্পের ভবিষ্যতকেও প্রশ্নের মুখে ফেলছে। একসময় চট্টগ্রামে ৩০টিরও বেশি ট্যানারি ছিল, যা স্বাধীনতার পরও ২২টি ছিল। বর্তমানে রিফ লেদার ছাড়া আর কোনো ট্যানারি সক্রিয় নেই। এটি চট্টগ্রামের চামড়ার মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ক্রয় করে। এছাড়া দেশের অন্য বিভাগ ও জেলা থেকেও তারা চামড়া সংগ্রহ করে।
জানা গেছে, চট্টগ্রামে এবার ৯ লাখের কাছাকাছি কোরবানি হওয়ার কথা জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে জানানো হলেও কাঁচা চামড়া আড়তদারদের চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা মাত্র সাড়ে ৪ লাখের মত।
সূত্র জানা গেছে, চট্টগ্রামে কোরবানি পশুর চামড়া সংগ্রহ হয় প্রায় চার লাখ। এরমধ্যে গরুর চামড়া প্রায় তিন লাখ এবং ছাগলের চামড়া প্রায় এক লাখ। অথচ এই বিশাল পরিমাণ চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য চট্টগ্রামে একমাত্র ট্যানারি হলো রিফ লেদার লিমিটেড। টিকে গ্রুপের এই প্রতিষ্ঠানটি বছরে এক লাখ পিস কাঁচা চামড়া কিনতে সক্ষম হয়। তাই মোট সংগ্রহের বড় অংশ প্রক্রিয়াজাতকরণের অক্ষমতায় সমস্যায় পড়েন আড়তদাররা। তাই চট্টগ্রামের সিংহভাগ চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য ঢাকার হাজারীবাগ ও সাভারে হেমায়েতপুরের ট্যানারিগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয়। এই নির্ভরতা চট্টগ্রামের আড়তদারদের জন্য এক দীর্ঘস্থায়ী সংকটের জন্ম দিয়েছে।
চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমিতির কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রামে প্রতি বছরই গড়ে ৩ থেকে ৪ লাখের মত কোরবানির কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে থাকেন চট্টগ্রামের কাঁচা চামড়া আড়তদারসহ ছোটখাট ব্যবসায়ীরা।গত বছর কোরবানির দিন চট্টগ্রামে আড়াই থেকে তিন লাখের মত কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেছিলেন চট্টগ্রামের কাঁচা চামড়া আড়তদার এবং খুচরা ব্যবসায়ীরা। পরবর্তীতে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় তিন লাখ ৬১ হাজার পিসে।
তবে জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা প্রতি বছর যে পরিমাণ কোরবানি হবে বলে তথ্য দেন-সেই পরিমাণ কোরবানি হয় না বলে জানান চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির আহ্বায়ক আবদুল জলিল। তিনি বলেন, জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা কিসের ভিত্তিতে বলেন সেটা আমরা বুঝি না। উনারা যে পরিমাণ কোরবানির কথা বলেন-কোরবানি শেষে আমরা সেই পরিমাণ চামড়া খুঁজে পাই না। আমরা আড়তদার সমিতিতে যারা আছি তারাসহ আরো কিছু খুচরা-ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মিলে প্রতি বছর গড়ে-৩৪ লাখের মত কোরবানি পশুর চামড়া পেয়ে থাকি। গতবার আমরা একেবারে দোহাজারী থেকে শুরু করে পতেঙ্গা, আগ্রাবাদ, বিবিরহাট, কাপ্তাই রাস্তার মাথা হয়ে রাউজান, হাটহাজারী, নাজিরহাট, ফটিকছড়ি পর্যন্ত ৪ লাখের কাছাকাছির কোরবানি পশুর কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেছিলাম। প্রতি বছর এরকমই; ৪ লাখের মত লবণজাত করে থাকি আমরা।
চট্টগ্রামের বৃহত্তর কাঁচা চামড়া আড়তদার-ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন বলেন, চট্টগ্রামে কাঁচামালের সহজলভ্যতা, সহজলভ্য শ্রমিক, পরিবহন সুবিধা এবং ব্যাংক ঋণ সুবিধাসহ সব ধরনের অবকাঠামোগত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নতুন ট্যানারি গড়ে উঠছে না। এটা খুবই দুঃখজনক।
এদিকে আড়তদারদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ ঢাকার ট্যানারিগুলোর বিরুদ্ধে। তাদের দাবি, ঢাকার ট্যানারি মালিকরা প্রতি বছর কোরবানির চামড়া বাকিতে কেনেন এবং সেই টাকা সময় মতো পরিশোধ করেন না। ২০১৫ সাল থেকে এই সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করেছে এবং ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে চট্টগ্রামের আড়তদারদের প্রায় ২৫ কোটি টাকা আটকা পড়ে আছে। এই বকেয়া পাওনা আদায় না হওয়ায় অনেক আড়তদার নিঃস্ব হয়ে গেছেন এবং তাদের ব্যবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
এ বিষয়ে আড়তদার সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ২০১৫ সালের সমস্যাটার কারণে আমাদের অনেকে ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। এখন আমরা যারা ব্যবসা করছি, তারাও নগদ টাকায় ব্যবসা করতে পারি না। যেমন গতবছরের টাকা আমরা এখনও পাইনি। তবে ২০১৬ সাল থেকে ট্যানারিগুলো আমাদের যে বছর চামড়া নেয় সেবছর একটা অংশ দেয়। আর বড় অংশের টাকা পরের বছর কোরবানির আগে দেয়। এটা নিয়ম করে ফেলেছে। লেনদেনটা যদি নগদ করা হতো, তাহলে আমাদের অনেক সুবিধা হতো।
সংগঠনটির সাবেক সহ-সভাপতি আবদুল কাদের সর্দার বলেন, পুঁজি হারিয়ে প্রায় ২৫০-৩০০ আড়তদার-ব্যবসায়ী থেকে এখন ২৫-৩০ জনে ঠেকেছে। অন্যরা দেউলিয়া হয়ে পড়েছেন। এখন যারা এ ব্যবসায় আছেন, তারা যদি পাওনা আদায় করতে না পারে তাহলে চট্টগ্রামে এ চামড়া ব্যবসা আরও খারাপ হবে।
তিনি আরও বলেন, এখনো মুখের কথায় চামড়া বেচাকেনা হয়। ট্যানারি মালিকেরা শুধু একটি স্লিপ দেন, তাতে আইনি ভিত্তি না থাকায় বকেয়া পাওনা নিয়ে বছরের পর বছর ঘুরছেন ব্যবসায়ীরা। এই মৌখিক লেনদেন এবং আইনি সুরক্ষার অভাব আমাদের অবস্থা আরও নাজুক করেছে।
এ নিয়ে আড়তদার সমিতির সাবেক সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন বলেন, আমরা চাই এ ব্যবসা রক্ষার স্বার্থে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। আর কোরবানে অনেক মৌসুমী ব্যবসায়ী চামড়া সংগ্রহ করে। তাদের কাছে অনুরোধ, তারা যেন পর্যাপ্ত লবণ সংগ্রহ করে। চামড়া সংগ্রহের পরপর লবণ মেখে তারপর বেচাবিক্রি করে। অথবা সময় নষ্ট না করে আমাদের কাছে তাড়াতাড়ি বিক্রি করে। যেন চামড়া নষ্ট না হয়। আর ট্যানারি চাইলে তো সেটা দিনে দিনে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তবে এ বিষয়ে যদি সরকারিভাবে ট্যানারি ব্যবসায়ীদের আগ্রহী করে তাহলে ভালো হবে।
চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতি সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুট ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় কেনা হয়। লবণ দেয়ার পর ট্যানারি মালিকরা যখন আমাদের কাছ থেকে চামড়া নিতে আসেন তখন তারা অনেক চামড়া বাদ দিয়ে দেন। আড়তদার সমিতির ব্যবসায়ীরা জানান, গুদাম ভাড়া নিয়ে, শ্রমিকের বেতন দিয়ে–লবণ দিয়ে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার পর ট্যানারি মালিকদের কাছে বাকিতে চামড়া বিক্রি করতে হয়।
চট্টগ্রামের আড়তদারদের অভিযোগ ঢাকার অনেক ট্যানারি মালিক বাকিতে চামড়া নিয়ে এক বছরেও টাকা পরিশোধ করেন না। যার কারণে অনেক আড়তদার লোকসানে পড়ে তাদের ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে দিয়েছেন।
চট্টগ্রামের কাঁচা চামড়া আড়তদাররা আরো জানান, চট্টগ্রামে আড়তদার সমিতিতে এখন ১১২ জনের মত সদস্য থাকলেও তার অর্ধেকও এখন এই পেশায় নেই। তারা এখন কোরবানির চামড়া সংগ্রহ করেন না।
