সাইফুল ইসলাম সাইফ: ঈদ মানেই আনন্দ আর এই আনন্দ তখনই পূর্ণতা লাভ করে যখন পরিবারের সবাই একত্রে মিলিত হয়ে উদযাপন করার সুযোগ মেলে। এই আনন্দ সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। জীবিকার প্রয়োজনে ইট-কাঠের শহরে আবাস গড়লেও আমাদের সবার মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও অর্থাৎ নিজ গ্রামে। যেখানে রয়েছে মানুষের নাড়ির টান। বাড়ি বহুদূর হলেও ঈদের মধ্যে প্রিয়জনের সঙ্গে মিলিত হতে চায় সবাই। খুশিকে আরো পরিপূর্ণ করতে এবং আপনজনকে দেখার আকাঙ্খা মেটাতে পথের কষ্ট নিয়ে ভাবে না কেউ। যেভাবেই হোক ঈদে বাড়ি পৌঁছানো চাই!
নগর জীবন কর্মমূখর। তবে গ্রামের সঙ্গে আমাদের আত্মিক সম্পর্কটি অটুট ও অম্লান। প্রতিটি জাতীয় উৎসব-পর্বে আমরা মাটির টানে উৎসে ফিরে যাই, স্বজনদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করি। এটি আমাদের সামাজিক সংহতিকেও সুদৃঢ় করে। বছরের অন্যান্য সময়ে ছুটিছাঁটা তেমন পাওয়া যায় না বলেই ঈদের সময় অনেক বেশি মানুষ শহর থেকে গ্রামে যান। আবার অনেকে আনন্দ ভ্রমণের জন্যও এই সময়টি বেছে নেন। নানা কারণে আমরা বিদেশি পর্যটকদের তেমন আকৃষ্ট করতে না পারলেও অভ্যন্তরীণ পর্যটন অনেক বেড়েছে। ঈদের সময় কক্সবাজার, কুয়াকাটাসহ দর্শনীয় স্থানগুলো পরিণত হয় জনারণ্যে।
বিশেষ করে এই যে ঈদে মাটির টানে বাড়ি ফেরা কিংবা আনন্দ ভ্রমণের জন্য বের হওয়া হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুর যাত্রাকে নিরাপদ করা সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব। ঈদের সময় নৌ, স্থল ও ট্রেনে যানবাহনের সংখ্যা অনেক বাড়ানো হয়। কিস্তু তারপরও যাত্রীর সংখ্যার তুলনায় তা অপ্রতুল। ফলে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়, যা অনেক সময় প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অতএব, ঈদে মাটির টানে যাওয়া এবং ঈদের পরে মানুষের ঘরে ফিরে আসা যাতে স্বস্তিদায়ক হয়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার সর্বোচ্চ সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, ঈদের আগে টিকিট পাওয়াটা যেন সোনার হরিণ পাওয়া। অনলাইনে টিকিট কাটার ক্ষেত্রেও দেখা যায় এক মিনিটের মধ্যেই যেন সব টিকিটি গায়েব হয়ে যায়। স্টেশনে সারারাত অপেক্ষা করে টিকিট সংগ্রহের যে কষ্ট তা আপনজনের সঙ্গে মিলিত হতে পেরে ক্ষণিকের মধ্যেই সেই কষ্টের কথা মানুষ ভুলে যায়।
মুসলমানদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসবের একটি হচ্ছে ঈদুল ফিতর, অন্যটি ঈদুল আজহা। এ দুই উৎসবে রাজধানী ও অন্যান্য শহর থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ নাড়ির টানে পরিবার-পরিজনসহ গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করে। আসন্ন ঈদুল ফিতরেও এর ব্যতিক্রম হবে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রতি বছর ঈদ উৎসবের আগমুহূর্ত থেকেই ঘরমুখী মানুষের মনে নিরানন্দের সুর ধ্বনিত হতে দেখা যায়। টিকিট কালোবাজারি, যানজট, ছিনতাই-ডাকাতি ও চাঁদাবাজি, জালনোট, সড়ক ও লঞ্চপথে দুর্ঘটনা এবং শ্রমিক অসন্তোষের কারণে রাস্তা অবরোধসহ বিভিন্ন ঘটনায় জনদুর্ভোগ চরমে ওঠে। অতীতের ঘটনা থেকে প্রমাণিত- দেশের কোনো পথই ঘরমুখী মানুষের ঈদযাত্রার জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। সড়কপথ, নৌপথ ও রেলপথ ঈদের আগে কোথাও স্বস্তির কোনো চিত্র পরিলক্ষিত হয় না। নিরাপদ ভ্রমণের প্রত্যাশা নিয়ে মানুষ টিকিটের জন্য বাস, লঞ্চ ও রেলস্টেশনে ভিড় জমায়। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের টিকিট পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। মূলত অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য অবৈধ পন্থায় টিকিটের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এ সময় মানুষকে উচ্চমূল্যে টিকিট কিনতে বাধ্য করা হয়। ঈদের আগে এ ধরনের অনিয়মণ্ডঅব্যবস্থা মোটেই কাম্য নয়।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ যাত্রী সড়কপথে বাড়িতে যায় এবং ফিরেও আসে সড়কপথে। তাই যাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য সড়কপথে যেন ফিটনেসবিহীন বাস কেউ নামাতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে। এমনকি ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই, এমন কেউ যাতে বাস বা অন্য কোনো যানবাহন চালাতে না পারে সেদিকেও নজর রাখতে হবে। কেউ যাতে রেষারেষি করে কিংবা প্রতিযোগিতা করে যানবাহন না চালায়, এ ব্যাপারে চালকদের সতর্ক করে দেওয়া জরুরি। আমরা জানি, ঈদের সময় ট্রেনেও উপচে পড়া ভিড় থাকে। টিকিট না পেয়ে অসংখ্য যাত্রী ছাদে উঠে গন্তব্যে যায়। কেউ বা ঝুলে যায়। দুর্ঘটনা ঘটলে দায় রেল বিভাগের ওপর পড়ে। সুতরাং কেউ যাতে ট্রেনের ছাদে উঠতে না পারে বা ঝুলে যেতে না পারে সেদিকে কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। নদীপথে ঈদের এ সময় ফিটনেসবিহীন লঞ্চ যেন নামতে না পারে। যাত্রীরাও যদি একটু সতর্ক থাকে, তাহলে ঈদযাত্রা হতে পারে নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন। বিশেষ করে সব থেকে বেশি ভোগান্তিতে পড়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ। আরিচা এবং মাওয়া ফেরিঘাটে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে হয় পারাপারের।
প্রতি বছরই দেখা যায়, ঘরমুখো অতিরিক্ত যাত্রীদের চাপে সড়কে গণপরিবহন ও নদীতে লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে। চাপ সামলাতে না পেরে নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি গাড়ি ওঠানোর ফলে মাঝপথে ফেরিডুবির ঘটনায় শত শত মানুষ মারা যায়। এমন ঘটনা বিরল নয়, যা রোজা কিংবা কোরবানির ঈদ এলেই দেখা যায়। আর এসব দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাওয়ার পর তদন্ত করে বলা হয় ফেরির ফিটনেস কিংবা লঞ্চে অদক্ষ চালকের কথা। তবে তাদের এই গতানুগতিক রিপোর্টে আর ফিরে আসে না হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো। প্রতি বছরই ঘরে ফেরা হয় না এমন বহু মানুষের। তা ছাড়া দেখা যায়, যানজটের কবল থেকে রেহাই না পেয়ে স্বল্পপাল্লার গাড়িতে চড়ে ফেরি বা লঞ্চের পরিবর্তে স্পিডবোটে পার হয় অনেক যাত্রী। দ্রুততার সঙ্গে নদী পাড়ি দিতেই মূলত তারা এই পদ্ধতি অবলম্বন করে। ঈদে যারা মাটির টানে ঘরে ফিরে যাবেন, যারা আনন্দ ভ্রমণে বের হবেন, তাদের সবার যাত্রা আনন্দময় ও নিরাপদ হোক এই কামনাই করি।
