১৮ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

অপেক্ষায় ছিল আ.লীগ, অন্য জেলার নেতাকর্মীরাও জড়ো হন গোপালগঞ্জে

অনলাইন ডেস্ক: গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রা ও সমাবেশে হামলা চালাতে আগে থেকেই একপ্রকার রণপ্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষায় ছিল নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। পূর্বপরিকল্পিত এ হামলা বাস্তবায়নে অন্য জেলার নেতাকর্মীদেরও গোপালগঞ্জে জড়ো করা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা, সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, গোপালগঞ্জে এনসিপির পদযাত্রা ও সমাবেশ কর্মসূচি ভণ্ডুল করতে বেশ কয়েকদিন থেকে প্রস্তুতি শুরু করে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তারা ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রামসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যোগাযোগ করে নিজেদের সংগঠিত করে।
এক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন গুজব ও উসকানিকে কাজে লাগানো হয়। বিশেষ করে দেশের বাইরে আয়েশি জীবনযাপনে থাকা নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারা বিভিন্ন রকম গুজব ছড়িয়ে আবেগী নেতাকর্মীদের অভ্যুত্থানের সংগঠকদের বিরুদ্ধে উসকানি দেন। সাধারণ নেতাকর্মীদের ‘কাফনের কাপড় পরে’ অপেক্ষায় থাকার উন্মাদনা ছড়ান সুইডেন, যুক্তরাজ্য, জার্মানি-সহ উন্নত দেশে ভোগবিলাসে জীবনযাপনরত আওয়ামী লীগের কিছু চিহ্নিত চরমপন্থি অ্যাকটিভিস্ট। এসব পোস্ট এখনো তাদের আইডিতে ভাসছে।
এতে অনেকে বুঝে না বুঝে সেদিন, অর্থাৎ বুধবার (১৬ জুলাই) এনসিপির নেতাদের স্বাভাবিক পদযাত্রায় হামলা চালাতে এবং তাদের টার্গেট করতে গোপালগঞ্জ ছুটে যান। পা দেন সহিংসতার ফাঁদে। রাষ্ট্রীয় বাহন ও স্থাপনায় হামলা-ভাঙচুরের মতো নাশকতায় জড়িয়ে পড়েন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষসহ এ সহিংসতা-নাশকতার মধ্যে ঝরে যায় চার প্রাণ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাগেরহাটের মোল্লাহাটের একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, মোল্লাহাট উপজেলার চরকুলিয়াসহ বেশ কিছু গ্রাম থেকে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী মোটরসাইকেলযোগে গোপালগঞ্জ গিয়ে সংঘর্ষে অংশ নেয়। তাদের সঙ্গে রামদা, ঢাল, সুরকিসহ বিভিন্ন রকম দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র ছিল।
একইভাবে আগে থেকেই গোপালগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম, ইউনিয়ন থেকে জেলা শহরে জড়ো করা হয় নেতাকর্মীদের। গোপালগঞ্জের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে যুক্ত হয় পাশের জেলা ফরিদপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, খুলনা, বাগেরহাট, নড়াইল জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা অনেক নেতাকর্মী।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকের ধারণা, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারাদেশের বিভিন্ন জেলার অনেক নেতাকর্মী গোপালগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপন করেন। তারাও এই হামলায় যুক্ত থাকতে পারেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা এনসিপির সমাবেশস্থল পৌর পার্কসহ গোপালগঞ্জের বিভিন্ন সড়কে হামলার ছক সাজায়। গ্রুপে গ্রুপে বিভক্ত করে তাদের অলিগলিতে অবস্থান নিতে বলা হয়।
জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় নেতারা গোপালগঞ্জে আসার আগেই পুলিশের গাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন এবং সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়িবহরে হামলা চালায় নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। এরপর এনসিপির সমাবেশ মঞ্চেও হামলা ও ভাঙচুর করে তারা। ঘটায় ককটেলের বিস্ফোরণ।
কিন্তু সব বাধা উপেক্ষা করে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা গোপালগঞ্জ পৌর পার্কে উপস্থিত হন। দেন বক্তব্যও। এই সমাবেশ শেষ করে নাহিদ ইসলাম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম, তাসনিম জারা, সামান্তা শারমিনসহ এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা যখন গোপালগঞ্জ ছেড়ে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠছিলেন, তখন পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে ফের হামলা শুরু করে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
ছক অনুযায়ী, এ হামলা বাস্তবায়নে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা আগে থেকেই পৌর পার্কের পথসভা মঞ্চের বাইরের সড়ক, এনসিপি নেতাকর্মীদের গাড়িবহর, মহিলা কলেজ ব্রিজ, লঞ্চঘাট ব্রিজ, বাজার ব্রিজসহ শহরের বিভিন্ন গলিতে লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান করেন।
জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাকর্মীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিভিন্ন দিক থেকে হামলা শুরু করে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এনসিপি নেতাকর্মীদের নিরাপদে সরে যেতে সহায়তা করেন।পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। দিনভর সহিংসতায় বিভিন্ন পক্ষের ৪ জন মারা যান, কয়েক ডজন মানুষ আহত হন।
হামলাকারীদের সহিংসতার বিষয়ে বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতা গত ১৬ জুলাই সংঘবদ্ধভাবে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও সরকারি যানবাহনে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হওয়ায় সেনাবাহিনী ও স্থানীয় পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে হস্তক্ষেপ করে এবং প্রাথমিকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
আইএসপিআর থেকে বলা হয়, সেনাবাহিনী হামলাকারীদের মাইকে বারবার ঘোষণা দিয়ে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে তারা সেনাবাহিনীর উপর বিপুল সংখ্যক ককটেল ও ইটপাটকেল ছুড়ে হামলা করে এবং একপর্যায়ে সেনাবাহিনী আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ যৌথভাবে বিশৃঙ্খলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
ঢাকা রেঞ্জের উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) রেজাউল করিম মল্লিক রেজা বলেন, তাদের কাছে খবর ছিল দুষ্কৃতিকারীরা বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রাম থেকে যুবকদের জড়ো করছে। এমনকি গোপালগঞ্জের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকেও যুবকদের আগে থেকেই জড়ো করার পরিকল্পনা ছিল।তিনি বলেন, পুলিশ সব কিছু মাথায় রেখেই কাজ করছিল। কিন্তু তারপরও কেন এমন ঘটনা ঘটলো, তা তদন্ত করা হচ্ছে। এখানে গাফিলতি থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।
এনসিপির গোপালগঞ্জ জেলা সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক মো. আরিফুল দাড়িয়া বলেন, এই হামলায় গোপালগঞ্জসহ পার্শ্ববর্তী বাগেরহাট, নড়াইল ও খুলনা জেলার কয়েকটি উপজেলা থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অংশ নেয়।তিনি বলেন, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন ইউনিটকে বিভিন্ন উপজেলার সড়কগুলোতে দায়িত্ব দেওয়া হয়, যাতে এনসিপির নেতাদের গাড়ি গোপালগঞ্জ থেকে বের হতে না পারে। এটা পূর্বপরিকল্পিত ছিল।পরিস্থিতি সামলাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কম সক্রিয় ছিলেন বলেও তিনি দাবি করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সহ-সমন্বয়ক ও খুলনা জেলা শাখার সদস্য সচিব সাজিদুল ইসলাম বাপ্পি বাংলানিউজকে বলেন, খুলনা থেকে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরা গোপালগঞ্জ গিয়ে এনসিপি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছে—এমন প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে।তিনি জানান, তারা বেশ কিছু ভিডিও সংগ্রহ করেছেন। সেগুলো যাচাই-বাছাই করছেন। বিষয়টি তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছেন। খুলনা থেকে যারা গিয়ে হামলা করেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।

আরও পড়ুন