২৩শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

হোটেল-রোঁস্তোরায় এত অভিযান, তবুও অনিয়ম

মোহাম্মদ জাহেদ উল্ল্যাহ ‌চৌধুরী: চট্টগ্রাম মহানগরীর হোটেল-রেস্টুরেন্টে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাসি, পচা ও ভেজাল খাবার অবাধে বিক্রি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। হোটেল-রেস্তোরাঁ আইন-২০১৬ এখানে কেউ মানছে না। ক্রেতারা রয়েছেন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। বিভিন্ন সময়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানা করলেও এখনও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্য পরিবেশন করছে বিভিন্ন নামিদামি হোটেল থেকে নিম্মমানের রেস্টুরেন্টগুলো। বেশ কয়েকটি নামিদামি রেস্টুরেন্টে অভিযান চালিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের জরিমানায় পড়তে হয় তাদের। কিন্তু ভেজাল থামছেনা। শেষ হওয়া সেপ্টেম্বর মাসে বিভিন্ন সংস্থা ৬৫টি অভিযান চালিয়েছে। যেগুলোর বেশিরভাগই হোটেল-রেস্তোরাঁ।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালত ছাড়াও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর নিয়মিত রেস্তোরাঁ-হোটেলে তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এর মধ্যে শুধু সেপ্টেম্বরেই নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের মহানগর অফিস ৪০টি এবং জেলা অফিস ২৫টি অভিযান পরিচালনা করেছে। যেগুলোর বেশিরভাগই হোটেল-রেস্তোরাঁ। এসব অভিযানে বহু রেস্তেরাঁ-হোটেলকে জরিমানা-সতর্ক করা হয়। মহানগরের তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে মামলাও করা হয়। পাশাপাশি সংস্থাটি সচেতনতা বাড়াতে খাদ্য কর্মীদের নিয়ে দুটি কর্মশালা, ৬টি উঠান বৈঠক, ১টি স্কুল প্রোগ্রাম ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ২৭০টি দেয়ালিকা টাঙায়।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও নগর ও জেলায় ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করে। এর মধ্যে জেলা কার্যালয় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২০২টি অভিযান পরিচালনা করে ২৭৬টি প্রতিষ্ঠানকে ৪৬ লাখ ৯৪ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করে। আর সর্বশেষ জুলাই ও আগস্ট মাসে ৫৯টি অভিযান চালিয়ে ৭১টি প্রতিষ্ঠানকে ১৫ লাখ ৭৪ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় অর্ধেকই হলো হোটেল-রেস্তোরাঁ। আর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয় এই ১৪ মাসে ৬২৮টি অভিযান চালিয়ে ৬৮৬টি প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি ৭৭ লাখ ৫০০ টাকা জরিমানা করে। এই সময়ে ৫৭টি সচেতনতামূলক সভা ও গণশুনানিও করে প্রতিষ্ঠান দুটি।
জানা গেছে, সময়ের পালাবদলে পারফিউম আর বডি স্প্রের ভিড়ে গোলাপজল ধর্মীয় আচার থেকে অনেকটা হারিয়ে এখন আশ্রয় নিয়েছে বিরিয়ানির পাতেই! সুগন্ধি খাবারের মোহে মানুষ অজান্তেই গিলছেন গোলাপজল নামের ওই ‘বিষ’।
চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ রেস্তোরাঁ থেকে হোটেল-সবখানেই এখন খাবারে ব্যবহার করা হচ্ছে গোলাপজল ও কেওড়া জল। শেষ হওয়া এই মাসে নগরীর চারটি রেস্তোরাঁয় অভিযান পরিচালনা করেছে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর। চারটিতেই খাবারে গোলাপজল ও কেওড়া জলের অস্তিত্ব পেয়েছে সংস্থাটি। এর মধ্যে গত ২৩ সেপ্টেম্বর খাবারে গোলাপজল ও কেওড়া জল ব্যবহার করায় জিইসি মোড়ের কাচ্চি ডাইন রেস্তোরাঁকে ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এর আগে ১৮ সেপ্টেম্বর একই এলাকার হান্ডি ও ধাবা নামের দুটি রেস্তোরাঁকেও একই অপরাধে আড়াইলাখ টাকা জরিমানা করে ভোক্তা অধিকার। সর্বশেষ গত ২৯ সেপ্টেম্বর নগরের বহদ্দারহাট এলাকার বিসমিল্লাহ ওরশ বিরিয়ানি ও মেজ্জান নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে একই কারণে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
এদিকে গোলাপজল-কেওড়া জল কোনোভাবেই খাবারে ব্যবহার করা যাবে না বলে জানিয়েছেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের নিরাপদ খাদ্য অফিসার মোহাম্মদ ফারহান ইসলাম। তিনি বলেন, খাবারের মধ্যে যদি ফুড এডিটিভস (খাদ্য সংযোজন) যুক্ত করতে হয় তাহলে সেটি হতে হবে অনুমোদিত। কিন্তু গোলাপজল-কেওড়া জল কোনোভাবেই খাবারের জিনিস নয়, এটি ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা এটা খাবারে ব্যবহার করছেন গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে। মানুষও সেসব খেয়ে মনে করছেন-আহ কি সুগন্ধি, বাবুর্চিটা দারুণ রান্না করেন। কিন্তু তারা যদি জানতো এটার ক্ষতিকর দিক-তাহলে মুখেও নিতেন না। এটা পুরোটাই বিভিন্ন রাসায়নিকের মিশেল। আর এটার গায়েও তাই লেখা থাকে।
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ বলেন, খাবারে গোলাপজল-কেওড়া জল নামের রাসায়নিক ব্যবহার এখন রীতি হয়ে গেছে। অথচ খাদ্যপণ্যে এই ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ। ব্যবসায়ীরা এলাচ-দারুচিনির পরিবর্তে সুগন্ধি হিসেবে এটা ব্যবহার করে আসছেন, কারণ এটা সস্তা। কিন্তু এসব উচ্চমাত্রার সিনথেটিক কেমিক্যাল মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। এই রাসায়নিক সেবনে পেটের গ্যাস্ট্রিক ও হজমজনিত সমস্যা, লিভার ও কিডনির ওপর প্রভাবসহ প্রাণঘাতী রোগের সম্ভাবনা রয়েছে। সেজন্য আমরা রেস্তোরাঁয় তদারকির সময় এই বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন কে বলেন, ভোক্তারা টাকা দিয়ে খাবার খান। কিন্তু রেস্তোরাঁ মালিকেরা তাদের খাওয়াচ্ছেন গোলাপজল-কেওড়া জল নামের রাসায়নিক। এভাবে বিষ খাইয়ে ভোক্তাদের মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলছেন তাঁরা। এটি শুধু খাদ্য নিরাপত্তা আইন লঙ্ঘন নয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনও বলে তিনি জানান।

আরও পড়ুন