সাইফুল ইসলাম সাইফ: প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী যাদের জীবন আছে তাদের কোনো না কোনো একদিন মৃত্যুবরণ করতেই হবে। কিন্তু সেই মৃত্যু যদি হয় অস্বাভাবিক, তখন প্রশ্ন তোলা স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায় যে, কেমন আছে মোদের সোনালি সবুজের নদীমাতৃক দেশ? আমরা জানি, প্রতিটি নাগরিকের জান, মাল ও সম্মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি আধুনিক ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। নাগরিকের নিরাপত্তা শুধু রাষ্ট্রীয় দয়ার বিষয় নয়, এটি তার সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু বাস্তবতা অত্যন্ত বেদনাদায়ক; আজকের বাংলাদেশে এই মৌলিক অধিকারটি নিশ্চিত নয়। নিখোঁজ হওয়া, গণপিটুনি বা গণধোলাই, ধর্ষণ কিংবা সন্ত্রাসের শিকার হয়ে খুনÑএসব ঘটনায় নাগরিকের স্বাভাবিক মৃত্যু যেন এক বিলাসিতা হয়ে উঠেছে। তাই ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাই’ এই আহ্বান এখন আর শুধু মানবিক আর্তি নয়, বরং এটি এক গভীর রাজনৈতিক ও নৈতিক দাবি হয়ে উঠেছে। এই দাবি রাষ্ট্রব্যবস্থার ব্যর্থতার বিরুদ্ধে জনগণের মৌলিক প্রতিক্রিয়া এবং ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ গঠনের প্রাথমিক শর্ত।
একটি রাষ্ট্র তার জনগণের জান, মাল ও সম্মানের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তখন সেই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব শুধু নামমাত্র থাকে তাকে আর কার্যকর, ন্যায্য বা নৈতিক রাষ্ট্র বলা চলে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায়, রাষ্ট্রের বৈধতা (লেজিটিমেসি) নির্ভর করে জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধানে তার সক্ষমতার ওপর। জন লকের ‘সামাজিক চুক্তি’ তত্ত্ব অনুসারে, মানুষ রাষ্ট্রকে যে ক্ষমতা দিয়েছে, তার মূল শর্তই ছিল ব্যক্তির নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। কিন্তু বাংলাদেশে সেই চুক্তির শর্ত বারবার লঙ্ঘিত হচ্ছে। এছাড়া প্রতিদিনের সড়ক দুর্ঘটনায় যেভাবে নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, তা অনিবার্য কোনো দুর্ভাগ্য নয়; বরং এটি দীর্ঘদিন ধরে চলা অনিয়ম, দুর্নীতি, অদক্ষতা ও জবাবদিহিতার অভাবের নিষ্ঠুর পরিণতি। অবৈধ রুট পারমিট, লাইসেন্সবিহীন চালক, ট্রাফিক আইনের প্রয়োগে শৈথিল্য সব মিলিয়ে এটি এক রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার প্রতিফলন।
বাংলাদেশের সমাজে ক্রমবর্ধমানভাবে একটি ভয়াবহ প্রবণতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে যে যখন তখন যে কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই প্রবণতাকে বাড়িয়ে তুলছে। ফলে হতাশাগ্রস্ত জনগণ নিজেরাই বিচারক ও শাস্তিদাতা হয়ে উঠছে। কেউ চোর সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হচ্ছে, কেউ আবার ‘ধর্ষকের বিচার রাস্তায়’ স্লোগানের ভেতরে রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে ভিন্ন ধারার বিচার দাবি করছে। প্রশাসনের উপস্থিতিতেই কখনও কখনও অপরাধীকে ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে। এসব ঘটনা শুধু বিচ্ছিন্ন উন্মত্ততা নয়, বরং আইন ও শৃঙ্খলার অবক্ষয়ের সুস্পষ্ট লক্ষণ।
যখন একটি সমাজের মানুষ সহিংস হয়ে ওঠে, একে অপরের রক্তে হাত রাঙায়, তখন সেই সমাজ আর মানবিক থাকে না তখন তা একধরনের আধুনিক বর্বরতায় পরিণত হয়। ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবি তার সভ্যতার বিশ্লেষণে বলেছিলেন, কোনো সভ্যতা বাইরে থেকে নয়, ভেঙে পড়ে ভেতর থেকে যেখানে সহানুভূতি বিলুপ্ত হয়, ন্যায়বিচারের জায়গা দখল করে হিংসা ও প্রতিহিংসা। আজকের সমাজে আমরা যেন সেই ভেতর থেকে ক্ষয়িষ্ণু মানবিকতাকেই প্রত্যক্ষ করছি। রাষ্ট্রের অব্যবস্থা যেমন মানুষের জীবন হরণ করছে, তেমনি সমাজের বিদ্বেষ, ধর্মীয় উগ্রতা, লিঙ্গবৈষম্য, সম্পদের লোভ, জমির বিরোধ বা রাজনৈতিক শত্রুতা এইসবই নাগরিকের স্বাভাবিক মৃত্যুর পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাষ্ট্রতত্ত্বে ‘আইনের শাসন’ বলতে বোঝায় কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং প্রতিটি অপরাধের জন্য শাস্তি বিচার রাষ্ট্রীয় বিদ্যমান বিচার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই সম্পন্ন হবে। কিন্তু যখন রাষ্ট্র এই মৌলিক নীতিকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তখনই আইনহীনতা ও প্রতিশোধপরায়ণতার এক অন্ধ সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যা সমাজকে ধীরে ধীরে অরাজকতার দিকে ঠেলে দেয়। এই অরাজকতা শুধু সমাজের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে ব্যাহত করে না; এটি মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর পথেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বিচারহীনতার বিরুদ্ধে জনরোষ এবং বিচারবহির্ভূত প্রতিশোধÑএই দুই চরম প্রবণতার ফলে সমাজে ন্যায্যতা, মানবিকতা ও স্বাভাবিকতার ধারণা ক্রমেই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এই সংকটময় ও অমানবিক বাস্তবতা থেকে উত্তরণে রাষ্ট্রের সামনে কিছু অপরিহার্য করণীয় রয়েছে, যা অবিলম্বে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাই’ এই আহ্বান শুধু একটি মানবিক আর্তি নয়, এটি নাগরিকের ন্যায্য অধিকার ও রাষ্ট্রের অপরিহার্য দায়িত্বের ঘোষণা। রাষ্ট্র যদি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারে, তবে তার অস্তিত্ব রাজনৈতিকভাবে বৈধ থাকে না। রাষ্ট্র হয়ে পড়ে নিছক এক দমনযন্ত্র, শাসনের খোলস। উন্নয়ন, অবকাঠামো, প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান কিংবা জীবনের জৌলুস এসব বাহ্যিক সাফল্য তখনই অর্থবহ হয়, যখন প্রতিটি নাগরিক নিশ্চিত থাকে যে সে একটি নিরাপদ ও মর্যাদাসম্পন্ন জীবন কাটাবে এবং একদিন সম্মানজনকভাবে স্বাভাবিক পথে মৃত্যুবরণ করবে।
রাষ্ট্রের সাফল্যের মাপকাঠি কোনো পরিসংখ্যানের সংখ্যা নয়, বরং তা নির্ধারিত হয় কতজন নাগরিক প্রতিকূলতা ছাড়াই বেঁচে থাকে, কতজনের জীবনে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়, আর কতজন শান্তিতে মৃত্যুবরণ করতে পারে। তাই রাষ্ট্রকে তার নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হবে মানবিকতা, ন্যায়বোধ এবং প্রতিটি নাগরিকের জান, মাল ও সম্মানের নিরাপত্তাকে। একমাত্র একটি মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক ও নিরাপদ রাষ্ট্রই নিশ্চিত করতে পারে এমন একটি সমাজ, যেখানে মানুষ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার ভোগ করে। -লেখক প্রকাশক, newschattogram24.net