৭ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বর্তমান প্রজন্ম সময় কাটাচ্ছে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় : প্রতিরোধ ব্যবস্থা শারীরিক শিক্ষা

সাইফুল ইসলাম সাইফ: প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির ফলে বর্তমান প্রজন্ম বেশিরভাগ সময় কাটাচ্ছে মোবাইল, কম্পিউটার বা ট্যাবলেট স্ক্রিনের সামনে। বিশেষ করে শিশু ও কিশোররা অনলাইন গেম, সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা ইউটিউব-নির্ভর জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। মাঠে ছুটে যাওয়ার জায়গায় তারা এখন ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ডুবে থাকে। এতে শরীরচর্চার অভাব তো হচ্ছেই, তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে তারা হারাচ্ছে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা ও পারস্পরিক যোগাযোগের দক্ষতা। এর ফলে তারা একদিকে যেমন শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন, হতাশ ও আবেগতাড়িত হয়ে উঠছে।

একটি সুস্থ দেহ কেবল দৈনন্দিন জীবনযাপনকেই সহজ করে না, বরং তা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ সব ক্ষেত্রেই ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে।আজকের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে শারীরিক শিক্ষা যেন আরও জরুরি হয়ে উঠেছে।
শুধু তাই নয়, পড়ালেখার চাপে, পরীক্ষার দৌড়ে এবং প্রতিযোগিতার ভিড়ে আজকের শিক্ষার্থীরা হারিয়ে ফেলছে নিজের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার আনন্দ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত স্কুল, কোচিং, প্রাইভেট এই চক্রে তারা একপ্রকার দমবন্ধ জীবনযাপন করছে। কাক্সিক্ষত ফল না পেলে হতাশায় ভুগছে, আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছে এবং কখনো কখনো আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে যা সমাজের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়।
এ বাস্তবতায় শারীরিক শিক্ষা হয়ে উঠতে পারে এক শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা। এটি শুধু শরীরকে সক্রিয় রাখে না, বরং মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করে, হতাশা ও অবসাদ দূর করে, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সহনশীলতা গড়ে তোলে। এর পাঠ্যবিষয়ে অন্তর্ভুক্ত থাকে শারীরিক সুস্থতা, মানসিক স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মাদক বিরোধী শিক্ষা, বয়ঃসন্ধিকাল সম্পর্কিত সচেতনতা, সামাজিক আচরণ, দলগত কাজের গুরুত্ব, এবং আরও অনেক জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়।
দার্শনিক প্লেটো ছিলেন শারীরিক শিক্ষার অগ্রপথিকদের একজন। তিনি প্রথম উপলব্ধি করেন যে, শারীরিক সুস্থতা মানুষের জ্ঞানচর্চা ও চিন্তনশীলতার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তার মতে, মানুষের সামগ্রিক বিকাশের জন্য কেবল মানসিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন সুসংগঠিত ও পরিকল্পিত শরীরচর্চা। এই দৃষ্টিভঙ্গি আজকের দিনে এসে আরও বাস্তবতা পেয়েছে, বিশেষ করে যখন প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে একদিকে সহজতর করেছে, অন্যদিকে বহু ক্ষেত্রেই মানবিক যোগাযোগ ও শারীরিক সক্রিয়তাকে কমিয়ে দিয়েছে।
আধুনিক শারীরিক শিক্ষা আর কেবল ক্রীড়া বা শরীরচর্চা শেখানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন একটি পূর্ণাঙ্গ একাডেমিক শাখা, যার লক্ষ্য হলো ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং বৌদ্ধিক বিকাশ। ‘শরীরের মাধ্যমে শিক্ষা এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সমকালীন শারীরিক শিক্ষা দর্শন। এটি এমন একটি বিষয়, যা পাঠ্যবইয়ের জ্ঞানের বাইরে গিয়ে জীবনের সঙ্গে শিক্ষার্থীর বাস্তব সম্পর্ক গড়ে তোলে। যেমনÑ দৈনন্দিন জীবনে সুশৃঙ্খলতা, সময়জ্ঞান, স্বাস্থ্য সচেতনতা, নেতৃত্ব, পারস্পরিক সহযোগিতা ইত্যাদি গুণাবলী গঠনে শারীরিক শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম।
উচ্চতর পর্যায়ে শারীরিক শিক্ষা একটি বৈজ্ঞানিক বিষয়ে রূপ নেয়। এখানে পড়ানো হয় জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, বায়োমেকানিক্স, কিনেসিওলজি, ব্যবস্থাপনা, ক্রীড়া বিজ্ঞান ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইত্যাদি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিষয়ে রয়েছে অনার্স, মাস্টার্স, এমপিএড, এমফিল ও পিএইচডির মতো উচ্চতর ডিগ্রি। ফলে এটি শুধু মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের একটি সহায়ক বিষয় নয়, বরং পেশাগত ও গবেষণাভিত্তিক একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শারীরিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিবাচক জীবনদৃষ্টি গড়ে তোলে। এটি ব্যক্তিকে পরিশ্রমী, শৃঙ্খলাপরায়ণ, নেতৃত্বদানে সক্ষম এবং সুস্থ দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন করে গড়ে তোলে। সমাজে গঠনমূলক ভূমিকা পালনের জন্য একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতেও সহায়তা করে শারীরিক শিক্ষা।-লেখক প্রকাশক, newschattogram24.net

 

আরও পড়ুন