অনলাইন ডেস্ক: শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের মুখে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রদর্শনী থেকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত নেতাদের ছবি সরিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন— ইসলামী ছাত্রশিবির।মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ছবিগুলো সরিয়ে নেওয়ার তথ্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর রফিকুল ইসলাম।তিনি বলেন, “আমি ছাত্রশিবিরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি তারা শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ছবিগুলো সরিয়ে নিয়েছেন।”জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এদিন ‘৩৬ জুলাই: আমরা থামবো না’ শীর্ষক কর্মসূচির অংশ হিসেবে যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত নেতাদের ছবির প্রদর্শনী করে ছাত্রশিবির, যা শিক্ষারর্থীদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়।
‘বিচারিক হত্যাকাণ্ড’ শিরোনামে এই প্রদর্শনীতে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল যুদ্ধাপরাধী মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, শুরা সদস্য মীর কাসেম আলী, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছবি স্থান পায়।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে তারা সবাই একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন।তাদের মধ্যে আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত সাঈদী কারাগারে মারা যান। ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বাকি ছয়জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের মত মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ ‘প্রমাণিত হওয়ায়’ তাদের দণ্ড দেওয়ার কথা বলা হয় ট্রাইব্যুনালের রায়ে।এছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমির গোলাম আযমকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ২০১৪ সালে কারাগারে থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তার ছবি শিবিরের এই প্রদর্শনীতে রাখা হয়নি।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উদ্যোগে মঙ্গলবার সকালে ঢাবির ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনে (টিএসসি) এ কর্মসূচির সূচনা হয়। সেখানেই দেখানো হয় এসব ছবি।ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া প্রত্যাখ্যান করে আসা জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের দাবি, তাদের এই নেতারা আওয়ামী লীগের আমলে ‘বিচারিক হত্যাকাণ্ডের’ শিকার।তবে জুলাই উদযাপনের অনুষ্ঠানে শিবিরের এমন আয়োজন নিয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী নউরিন সুলতানা তমা বলেন, “৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থান দিবস উদযাপনে চিহ্নিত গণহত্যাকারী রাজাকারদের ছবি টাঙিয়ে আমি মনে করি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কলঙ্কিত করেছে। গণহত্যাকারীদের ছবি দিয়ে তারা স্পষ্ট বার্তা দিলেন–গণঅভ্যুত্থানকে তারা ব্যবহার করতে চাইছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীতার বার্তা বাস্তবায়নে।”
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সর্ব মিত্র বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে ছাত্রশিবির কর্তৃক টিএসসিতে রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের ছবি প্রদর্শন করার প্রতিবাদে তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। একাত্তরের রক্ত শুকিয়ে যেতে পারে, কিন্তু একাত্তরে যারা ধর্ষণ-নারকীয় গণহত্যা চালিয়েছে, তা আমরা ভুলতে পারি না।“একাত্তর-চব্বিশ উভয় আমাদের ইতিহাসের অংশ, যারা একাত্তর আর চব্বিশকে মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে রাজাকারদের পক্ষে বয়ান তৈরি করতে চায়, তাদের প্রতি চরম ঘৃণা।”
এই শিক্ষার্থী বলছেন, গতবছর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তখনকার প্রধানমন্ত্রীর এক বক্তব্যের কারণে ১৪ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘আমি কে? তুমি কে? রাজাকার রাজাকার’ স্লোগানে ফেটে পড়েছিল ক্ষোভে, কারণ ‘রাজাকারের মত ঘৃণ্য এক তকমা’ তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল।“যদি ছাত্রশিবির মনে করে তারা সেই শিক্ষার্থীদের কাছে রাজাকারদের গ্লোরিফাই এবং নরমালাইজ করবে, তাহলে এটা তাদের জন্য ঘৃণাই বয়ে আনবে।”
এই ক্ষোভের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেন, “একাত্তর বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এটাকে কোনো ছাত্র সংগঠন অস্বীকার করার সুযোগ নাই।“আমরা দেখেছি শেখ হাসিনার স্কাইপি কেলেঙ্কারি, হাসিনা নিজের মত করে বিচার ব্যবস্থাকে সাজিয়েছে। ইচ্ছামত রায় দিয়েছে। সাক্ষীকে গুম করে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছে, আইনজীবীকে গুম করে আয়নাঘরে বন্দি রেখে নির্যাতন করেছে। তাই, আমরা এটাকে ‘বিচারিক হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে রেখেছি।”
তিনি বলেন, “ফ্যাসিবাদী আমলে যা যা ঘটেছে, আমরা সবকিছুকে আনার চেষ্টা করেছি। তাই আমরা এটাকে সামনে রেখেছি।
“এ বিচার ব্যবস্থা সুষ্ঠু নয়। এটা যদি নিরপেক্ষ হত আমরা মেনে নিতাম। কিন্তু আওয়ামী লীগের আমলে যে বিচার ব্যবস্থা তা প্রশ্নবিদ্ধ।”
তিন দিনব্যাপী এই আয়োজন শেষ হবে আগামী ৭ অগাস্ট। আয়োজনে থাকবে জুলাইয়ের চিত্র প্রদর্শনী, জুলাই বিপ্লব নিয়ে ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী, বিপ্লবের গান ও কবিতা, শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধাদের গল্প, গান, কবিতা, নাট ও মাইম, প্লানচেট বিতর্ক ও আলোচনা সভা।এর আংশ হিসেবে টিএসসির সবুজ চত্বরে তৈরি করা হয়েছে প্রতীকী গণভবন, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ফতেহ গণভবন’। নির্মাণ করা হয়েছে ‘৩৬ জুলাই এক্সপ্রেস’।এছাড়া জুলাইয়ের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ছবি ও স্লোগান দিয়ে তৈরি করা হয়েছে প্রদশর্নী। সেখানে দেখানো হয়েছে নারী চরিত্রের বিপ্লবী চেহারা, গণভবন দখলের চিত্র, আবু সাইদসহ শহীদদের ছবি।
