মোহাম্মদ জাহেদ উল্র্যাহ চৌধুরী: চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন সেবা খাতের মাশুল বা ট্যারিফ দীর্ঘদিন পর উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হচ্ছে। যা সরকারি গেজেট জারির অপেক্ষায় রয়েছে। নৌপরিবহন উপদেষ্টা চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিদর্শনে এসে বন্দরের ট্যারিফ বাড়ানোর কথা বলেন। তবে কত শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে সে বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলেননি তিনি। তবে বন্দর ব্যবহারকারীদের মতে ‘মরার ওপর খাড়ার ঘা‘।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, তাদের প্রস্তাবের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মাশুল নির্ধারণ করা হচ্ছে। এটি তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। বন্দর ব্যবহারকারীরা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত মাশুল বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। একবার আলোচনার পর আর এ বিষয়ে তাদের সাথে বসা হয়নি।এক লাফে অনেক বেশি হারে মাশুল বাড়ানোর খবর শুনে বন্দর ব্যবহারকারীরা আশঙ্কা করছেন এর প্রভাব দেশের সামগ্রিক ব্যবসা খাতে পড়বে। সবশেষে মোটাদাগে এর প্রভাব ভোক্তা পর্যায়েই পড়বে বলে মত তাদের।
শিপিং এজেন্টস অ্যাসেসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, বন্দরে বিভিন্ন লাইনে (খাতে) মাশুল বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে সেসবের সঙ্গে একমত নই। এখন মাশুল বাড়ানোর সময়ও নয় বলে মনে করি। সবমিলিয়ে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মাশুল নতুন করে বিবেচনা করা উচিত বলে আমি মনে করি। মূলত দেশের সামুদ্রিক জলসীমায় পণ্য বা কন্টেইনারবাহী জাহাজ আসার পর থেকে সেগুলোকে দেওয়া সেবার বিপরীতে ট্যারিফ বা মাশুল নিয়ে থাকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
মূলত জাহাজ পরিচালনাকারী কোম্পানি, কন্টেইনার পরিচালনাকারী কোম্পানি এবং আমদানি ও রপ্তানিকারকরা এসব মাশুল দিয়ে থাকে। জাহাজ মালিকদের পক্ষ থেকে শিপিং এজেন্ট এবং আমদানিকারকদের পক্ষ হয়ে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা এসব মাশুল পরিশোধ করে থাকেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, ট্যারিফ বা মাশুল বাড়ানোর বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তির পর সেটি আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। অনুমোদনের পর গেজেট হবে এবং কখন থেকে সেটি কার্যকর হবে তা গেজেটে বলা থাকবে। ১৯৮৬ সালে সর্বশেষ চট্টগ্রাম বন্দরে বিভিন্ন সেবার মাশুল বাড়ানো হয়েছিল দাবি করে তিনি বলেন, এরপর আর বাড়েনি। সবমিলিয়ে গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের মত বাড়ছে। এর মধ্যে কোনটির কমছে বা কোনটির বাড়ছে।তার দাবি, দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানকে হিসাবে নিলে মাশুল ‘খুব বেশি’ বাড়ছে না।
বন্দর সচিব ওমর ফারুক আরো বলেন, বন্দরের সেবার মান বাড়ানোর জন্য মাশুল বাড়ানো হচ্ছে। বন্দরের সক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। আধুনিক যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাও বেড়েছে। এটি একটি সরকারি সংস্থা। সুযোগ-সুবিধা ও সেবার মান বাড়ানোর জন্য মাশুল বাড়ছে।
বন্দর ব্যবহারকারী সংগঠনের এক নেতা বলেন, গত ২ জুন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে বন্দরের মাশুল (ট্যারিফ) হালনাগাদ করার জন্য সভা হয়েছিল। সেখানে বন্দর ব্যবহারকারীরা তাদের মত দিয়েছেন। কিন্তু আর কোনো আলোচনা না করেই চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে, এটা দু:খজনক। বর্তমান পরিস্থিতিতে মাশুল বাড়ানো মানে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং এর প্রভাব গিয়ে ভোক্তা পর্যায়ে পড়বে।
চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বন্দরের আদায় করা সবধরণের মাশুল ১৯৮৬ সালে নির্ধারণ করা। এরপর ৪০ বছরে নতুন করে মাশুল বাড়ানো হয়নি। শুধু ২০০৭-০৮ অর্থবছরে অত্যাবশ্যকীয় বিবেচনায় পাঁচটি মূল ট্যারিফ আইটেম বাড়ানো হয়। এর আগে ১৯৯৬ এবং পরে ২০১২ সালে দুই দফা তা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হলেও কার্যকর হয়নি। ২০২০ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ নতুন করে মাশুল বাড়ানোর কাজ শুরু করে এবং স্পেনভিত্তিক একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ট্যারিফ হালনাগাদ করে বন্দরের কাছে ২০২২ সালে জমা দেয়। বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ আলোচনার পর মাশুল বাড়ানোর প্রস্তাব চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, বন্দরে ৫২টি খাতে মাশুল আদায় করা হয়ে থাকে। আদায়ের সামঞ্জস্য এনে সেটি ২৩ টিতে আনা হয়েছে।
বন্দর ব্যবহারকারীদের হিসাবে, ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ বর্তমানে ৪৩ ডলারের মত। প্রস্তাবিত নতুন মাশুলে তা হবে ৭০ ডলারের কিছু বেশি। এছাড়া আমদানি করা পণ্যভর্তি কন্টেইনার বন্দরের ইয়ার্ডে প্রথম চার দিন বিনা মাশুলে রাখা যায়। পরের একদিনে কন্টেইনার প্রতি মাশুল দিতে হয় ৬ ডলার, নতুন হারে তা পড়বে ৬ দশমিক ৯ ডলার।
শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, বন্দরের ট্যারিফ বাড়ানোর ফলে দেশের শিল্পায়ন, বাণিজ্য ও সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। উন্নয়ন অবশ্যই কাম্য, কিন্তু সেই উন্নয়ন হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই এবং দেশের সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিতকারী।চট্টগ্রাম বন্দর এমনিতেই লাভজনক প্রতিষ্ঠান। এটির আয়ের অর্থ ব্যয় করে বন্দরের আধুনিকায়ন থেকে শুরু করে সকল ব্যয়ের পরও বিপুল অর্থ সঞ্চিত থাকে। ট্যরিফ বাড়ানোর সিদ্ধান্তে বাণিজ্যে ও শিল্পে মন্দা এবং সামস্টিক অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে।
তিনি বলেন, ট্যারিফ বাড়ানোর অর্থ হল আমদানি-রপ্তানির খরচ বাড়বে, যা সরাসরি প্রভাব পড়বে পণ্যের বাজারমূল্যে এবং পরোক্ষভাবে এই চাপ গিয়ে পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। বিশেষত যেসব কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য আমদানিনির্ভর সেগুলোর মূল্যবৃদ্ধি দেশের সাধারণ জনগণের ওপর চাপ তৈরি করবে।
বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি এস এম আবু তৈয়ব বলেন, এমনিতেই ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই নানামুখী চাপে রয়েছে এবং ব্যবসা আগের চেয়ে অনেক প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ আগের চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে। এর মধ্যে বন্দরের বিভিন্ন খাতে ট্যারিফ বাড়ানো হবে ‘মরার ওপর খাড়ার ঘা‘।
অপর এক ব্যবসায়ী বলেন, তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, হালকা প্রকৌশল খাত ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে লড়াই করছে। এই অবস্থায় ট্যারিফ বাড়ালে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে এবং রপ্তানিপণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।মাশুল বাড়লে ব্যবসার খরচ বাড়বে এবং এর প্রভাব ভোক্তা পর্যায়ে পড়বে এমন অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।