নিজস্ব প্রতিবেদক: পণ্য রপ্তানি বাড়ছে। ডলার সংকট কাটিয়ে আমদানিও স্বাভাবিক হয়েছে। আমদানি-রপ্তানির ওপর ভর করে কনটেইনার পরিবহনে নতুন উচ্চতায় জায়গা করে নিল চট্টগ্রাম বন্দর। বিশেষ করে ৪৮ বছরের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমান আয় হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস. এম. মনিরুজ্জামান দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই নানা বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং গৃহীত সময়ে অনুযায়ী তা কার্যকর এর ফলে এই রেকর্ড আয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বন্দর সূত্র এবং বার্থ অপারেটরদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রিয়ার অ্যাডমিরাল এস. এম. মনিরুজ্জামান ২০২৪ সালের ১১ আগস্ট একটি একক গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, যেখানে তিনজন রিয়ার অ্যাডমিরালের বদলি করা হয়েছিল। তিনি অত্যন্ত চরম সংকটপূর্ণ সময়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, যখন দেশ তখন এক ফ্যাসিবাদী শাসনের কবল থেকে সদ্য মুক্ত হয়। এই সময়ে বন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার ও পুলিশ সদস্যরা ব্যাপকহারে পালিয়ে যায়। এমনকি বন্দর থানা সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে যায় এবং অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদের ও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না । এমতাবস্থায় বন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটা ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জের , যা তিনি সাহসিকতার সঙ্গে পালন করেন তিনি।
তাইতো গ্রহণের পূর্বে ২১ দিনের ছাত্র- জনতার আন্দোলন ও ৭ দিনের ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বন্দর কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হয়। কন্টেইনার আটকে যায়, চট্টগ্রামে ৫৪,০০০ এবং ঢাকার আইসিডিতে ২,৫০০। অপেক্ষার সময় ১ দিন থেকে বেড়ে ৬-৮ দিন হয়ে যায়। কন্টেইনার ডুয়েল টাইম হয় ৫-৬ দিন, যা আগে ছিল ২-৩ দিন। জাহাজের টার্ন-অ্যারাউন্ড টাইম ২-৩ দিন থেকে ৫-৬ দিনে পৌঁছায়। এই জটিলতা দূর করতে তিনি রেলওয়ের সহযোগিতায় ট্রেন সংখ্যা দ্বিগুণ করেন এবং কাস্টমস কর্মকর্তাদের ২৪ ঘণ্টা কাজ করার ব্যবস্থাও করেন।
বন্দরে থাকা অত্যন্ত বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্যসমূহ ২ মাস ১৫ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করা হয়, যা বন্দরে বৈরুতের মতো ভয়াবহ মতো বড় বিস্ফোরণ ঘটতে পারতো।এছাড়া প্রায় ১০,০০০ টিইইউ কন্টেইনার ও ৪৫০টির মতো যানবাহন প্রায় ২০ বছর ধরে বন্দরে পড়ে ছিল, যা বন্দরের ২৫% ধারণক্ষমতা দখল করে রেখেছিল। এসব নিলাম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিক্রি করে ৩,৫০০ কোটি টাকা আয় নিশ্চিত করেন এবং বন্দরকে কার্যকর করে তোলেন।
ই-জিপি (ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রোকিওরমেন্ট) ও ওটিএম (ওপেন টেন্ডার মেথড) পদ্ধতি ব্যবহার করে চট্টগ্রাম বন্দরে ‘টেন্ডারবাজি’ বন্ধ করা হয়, যা আগে ডিপিএম (ডাইরেক্ট প্রোকিওরমেন্ট মেথড) পদ্ধতিতে হতো। এতে যে কেউ টেন্ডারে অংশ নিতে পারত এবং বন্দর কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ সুবিধাজনক দামে চুক্তি প্রদান করতে সক্ষম হয়। এভাবে টেন্ডার সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হয়।
মনিরুজ্জামানের সবচেয়ে সাহসী পদক্ষেপ ছিল নিউ মুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) সিন্ডিকেট ভাঙা, যা সাইফ পাওয়ারটেক নামের একটি শক্তিশালী মাফিয়া সংগঠন দ্বারা ১৭ বছর ধরে পরিচালিত হচ্ছিল। সাইফ পাওয়ারটেকের বেতনভুক্ত বন্দর কর্মীদের তীব্র বিরোধিতার মুখেও তিনি গত ৭ জুলাই এনসিটি সফলভাবে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম ড্রাই ডক লিমিটেড (সিডিডিএল)-এর হাতে হস্তান্তর করেন। এরপর থেকে দৈনিক কন্টেইনার হ্যান্ডলিং ৭% বৃদ্ধি পায় (টিবিএস রিপোর্ট)। বন্দর চেয়ারম্যানের অন্যতম যুগান্তকারী প্রকল্প ছিল বে টার্মিনাল উদ্যোগ।
বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, বে টার্মিনাল চালু না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রতিদিন ১০ লাখ ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছিল। উক্ত ক্ষতি নিরসনে মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ, ডিপিপি অনুমোদন ও ৬ মাসের মধ্যে সরকারি স্বীকৃতি আদায় করা হয়। বিশ্বব্যাংকের সাথে ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ডিপি ওয়ার্ল্ড, পিএসএ সিঙ্গাপুর, আবুধাবি পোর্টের মতো বড় বন্দর অপারেটররা এতে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে। এই বন্দরে জাহাজ ২৪/৭ এবং জোয়ার-ভাটা না দেখেই আসতে পারবে।এছাড়া তিনি বন্দর এলাকার পরিবহন সিন্ডিকেট ভেঙে দেন ই-টিকিটিং চালুর মাধ্যমে। এতে পরিবহন খরচ ২৫% হ্রাস পায় এবং বন্দরে যানজট কমে যাওয়ায় কার্যকারিতা ও গতি বৃদ্ধি পায়।
সমাজসেবামূলক কাজ হিসেবে তিনি গত ১৬ এপ্রিল নগদ ১০০ কোটি টাকার চেক হস্তান্তর করেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ড. শাহাদাত হোসেন কে। এর পূর্বে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করা কোন বন্দর চেয়ারম্যান এত বড় অনুদান প্রদান করতে পারেননি। এর পাশাপাশি চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতা কমাতে নালা ও খাল ড্রেজিং কার্যক্রম শুরু করেন, রোড শো ও সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন এবং ৫০০০ ডাস্টবিন উপহার দেন।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরের আয় ছিল ৫,২২৭ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ৮.২২% বেশি এবং বন্দরের ৪৮ বছরের ইতিহাসে যা রেকর্ড আয়। নিট উদ্বৃত্ত ছিল ২,৯১২ কোটি টাকা (৭.২৭% বৃদ্ধি)। কর্পোরেট ট্যাক্স ৭২৮ কোটি, ভ্যাট ৬৬৭ কোটি টাকা প্রদান করে মোট ১,৭৬৫ কোটি টাকা জাতীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হয়, যা গত ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বিশ্লেষকদের মতে, বন্দরের চেয়ারম্যানের দূর দৃষ্টি,বাস্তবভিত্তিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সাহসের সাথে তা যথার্থভাবে কার্যকরনের ফলেই এই সাফল্য, যা সত্যিই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য ।