৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

চট্টগ্রামের আসছেন নতুন ডিসি, নারায়ণগঞ্জে সংবর্ধিত

নিজস্ব প্রতিবেদক: দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই একের পর এক উদ্যোগে দৃষ্টি কাড়েন নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা। মানবিক ডিসি হিসেবেও পরিচিতি পান। রবিবার (১৬ নভেম্বর) তিনি নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আলমগীর হোসেনের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে বিদায় নেন।মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) সকালে তিনি চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেবেন।
বিদায় উপলক্ষ্যে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে রাজনৈতিক, পেশাজীবী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য সংগঠনের নেতারা ভিড় জমাতে থাকেন। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে অফিস প্রাঙ্গণ। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা–কর্মচারীরাও বিদায়ী ডিসিকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। রাতে জেলা প্রশাসকের বাংলোয় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
মানবিক জেলা প্রশাসক হিসেবে পরিচিত জাহিদুল ইসলাম মিঞা বিদায়ের শেষ মুহূর্তেও রেখে আসেন আরেকটি মানবিক দৃষ্টান্ত— শারীরিক প্রতিবন্ধী এক দুস্থ কবিকে নিজের বাসায় আপ্যায়ন করে অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক হুইলচেয়ার উপহার দেন তিনি।
শারীরিক প্রতিবন্ধী কবি ইমরান আহম্মেদ (৪৬)—সালেহনগর এলাকার আলী আহাম্মদ ও রহিমা বেগম দম্পতির ছেলে। চারটি গল্পগ্রন্থ, উপন্যাস ও কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তার। জন্মগত অসুস্থতার কারণে শরীরের প্রায় সব অঙ্গই বিকল। দরিদ্র মা–বাবার ওপর নির্ভর করে চলতে হয় তাকে। চলাচলের জন্য একটি ইলেকট্রিক হুইলচেয়ার প্রয়োজন হলেও পরিবারের পক্ষে তা কেনা সম্ভব হয়নি।বিদায় অনুষ্ঠানের মাঝেই জেলা প্রশাসক তাকে ডেকে কুশলাদি বিনিময় করেন এবং নিজের হাতে ইলেকট্রনিক হুইলচেয়ার উপহার দেন। কবিকে ও তার পরিবারকে রাতের খাবারও খাওয়ান তিনি। অতিথিরা তার এই মানবিকতার প্রশংসা করেন।
হুইলচেয়ার পেয়ে ইমরান বলেন, ‘মানুষ মানুষের জন্য— এই বাণীটা আজ আমার জীবনে সত্যি হলো।’ তিনি জানান, তার দুরবস্থার কথা জেলা প্রশাসক জানতে পারেন ‘মায়ের আঁচল সাহিত্য সামাজিক মৈত্রী পরিষদ’-এর প্রতিষ্ঠাতা হারুনুর রশীদ সাগরের মাধ্যমে।
তিনি বলেন, ‘ডিসি স্যার অভিভাবকের মতো পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিলেন— আজ বাস্তব রূপ পেল। এই চেয়ার শুধু চেয়ার নয়, আমার জীবনের নতুন আশার আলো।’এর আগে দুপুরে কার্যালয়ে বিদায়ের সময় জেলা প্রশাসনের বহু কর্মকর্তা–কর্মচারীর চোখে অশ্রু দেখা যায়। সংক্ষিপ্ত দায়িত্বকালেই অসংখ্য মানবিক উদ্যোগে তিনি হয়ে ওঠেন নারায়ণগঞ্জের ‘অভিভাবক’।
স্থানীয় সূত্র জানায়— বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত–আহত পরিবার, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী, দুস্থ মানুষ, অসহায় শিশু, কারাবন্দি, ঝুঁকিপূর্ণ রোগী—সবার নির্ভরযোগ্য ঠিকানা ছিলেন তিনি।দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সোহাগকে স্মার্টফোন, সালমা জেরিনকে ল্যাপটপ, ২০ প্রতিবন্ধীকে হুইলচেয়ার, শিশুদের শিক্ষা উপকরণ, অসংখ্য রোগীর চিকিৎসায় সহায়তা— সবখানেই ছিল তার মানবিক স্পর্শ।
জুলাই শহীদ পরিবারের জন্য ৪২ লাখ টাকা, আহত ২১২ যোদ্ধাকে অনুদান, এতিমখানার ৮২ শিশুকে ইফতার ও পাঞ্জাবি, কারাবন্দিদের জন্য ক্রিকেট টুর্নামেন্ট— মানবিকতার ছাপ স্পষ্ট। সবচেয়ে আলোচিত ছিল গ্রিন অ্যান্ড ক্লিন নারায়ণগঞ্জ কর্মসূচি এবং মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে তার দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ।হাসপাতালের আইসিইউ চালু, হুইলচেয়ার প্রদান, সিবিসি–ইসিজি মেশিন সরবরাহ, ফুটবল অ্যাকাডেমির শিশুদের সহায়তা—উন্নয়ন কাজেও রেখেছেন অবদান।
শতবর্ষী হকার ফজিলাতুন্নেছাকে পুঁজি প্রদান কিংবা বিল না থাকায় লাশ আটকে রাখার ঘটনায় পিংকির মরদেহ ১৪ ঘণ্টা চেষ্টায় পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া— তার মানবিকতার স্মরণীয় উদাহরণ।
পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচিতে ফটোসেশনের বদলে নিজের হাতে সিরিঞ্জ কুড়িয়ে ফেলা, প্রকাশ্য লটারিতে ৩০ ইউপি কর্মকর্তার বদলি, ১১২ টাকায় সরকারি চাকরি— স্বচ্ছতারও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি।মা–শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে সিজার বন্ধ হলে ডায়াথার্মি মেশিন সরবরাহ, নারী ফুটবলারদের পাশে দাঁড়ানো— সবকিছুতেই ছিল তার তৎপরতা।মানুষের সুখ–দুঃখে নিরবচ্ছিন্ন উপস্থিতি, দ্রুত সিদ্ধান্ত ও মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন নারায়ণগঞ্জের অঘোষিত জনপ্রতিনিধি।
এর আগে, ২০২৪ সালের ২ নভেম্বর রাজবাড়ীতে যোগ দিয়েও দ্রুত জনবান্ধব প্রশাসক হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে সারা দেশে আলোচনায় আসেন।১৯৭৯ সালে টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরে জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে অনার্স–মাস্টার্স, রাশিয়ান ভাষায় ডিপ্লোমা এবং যুক্তরাজ্য থেকে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় এমএসসি করেন।২০০৬ সালে ২৫তম বিসিএসের মাধ্যমে প্রশাসনে যোগ দেন। বিভিন্ন জেলায় এনডিসি, এসিল্যান্ড ও ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কমলগঞ্জে ইউএনও থাকাকালে জেলার শ্রেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা হন।বিদায়ের খবর ছড়িয়ে পড়তেই সাধারণ মানুষ বলেন— তার মানবিকতা, বিনয় ও জনবান্ধব আচরণ তারা ভুলবেন না।সোমবার (১৭ নভেম্বর) রাতে চট্টগ্রামের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম। মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) সকাল থেকে তিনি চট্টগ্রামের নতুন জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেবেন।

আরও পড়ুন