১৯শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পরিণতি কী হতে পারে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইরানে হামলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প যাই বলুন না কেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলেছেন। তার এই পদক্ষেপ খুবই গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী পরিণতিই ডেকে আনবে।বোমা হামলায় ইরান পিছু হটে যাবে না। এই হামলার কারণে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর জ্ঞান ধ্বংস হবে না কিংবা ইচ্ছাও নস্যাৎ হবে না, যদি ইরানের ইচ্ছা সেটাই হয়ে থাকে।ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যে হামলা চালালেন, তাতে ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের চলমান সংঘাত বন্ধ হবে না। মধ্যপ্রাচ্যেও এই পদক্ষেপ স্থায়ী শান্তি বয়ে আনবে না,গাজায় হামলায় মানুষের মৃত্যু বন্ধ হবে না, ফিলিস্তিনিরা ন্যায়বিচার পাবে না কিংবা তেহরান এবং ওয়াশিংটনের মধ্যকার অর্ধশতাব্দীর তিক্ত শত্রুতারও অবসান হবে না।বরং ট্রাম্পের হঠকারী পদক্ষেপ এবং তার বেপরোয়া জুয়া বিদ্যমান সমস্যাগুলোকেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতোই আরও বাড়িয়ে দেবে।ট্রাম্পের হামলার কী ধরনের জবাব ইরান ও এর মিত্র ও সমর্থকরা দেবে তার ওপর নির্ভর করছে এ অঞ্চলের পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে সেটি। তারা জবাব দেওয়া শুরু করলে এ অঞ্চলের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।পারস্য উপসাগর এবং এ অঞ্চলের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি। যেগুলোতে আছে প্রায় ৪০ হাজার মার্কিন সেনা। এই ঘাঁটিগুলোই এখন যুক্তরাষ্ট্রের ইরানে হামলার জবাবের ক্ষেত্রে নিশানা হতে পারে। ব্রিটিশ ও তাদের মিত্রদেশগুলোর বাহিনীও হামলার নিশানা হতে পারে।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পরও ট্রাম্পের দাবি তিনি ইরানে যুদ্ধ ঘোষণা করেননি। মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে জড়ানোর কোনও আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্রের নেই- এমন কথা বলেছেন ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স।
মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক শান্তি নিশ্চিত করতেই শনিবার রাতে ইরানে সীমিত পরিসরে হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি তার। কিন্তু ইরানের রাজনীতিবিদরা এবং জনগণ বিষয়টিকে এভাবে দেখবে না।
ট্রাম্প ইরানে হামলার পরপরই ‘অসাধারণ সফল অভিযান’ হয়েছে বলে যে বড়াই করেছেন এবং ইরান কথা না মানলে আরও হামলা করার যে হুমকি দিয়েছেন, তা অনেকটা বেপরোয়া এক বিজেতার মতোই শোনায়, যার অভিপ্রায় সবকিছু বিদীর্ণ করে দিয়ে জয় পাওয়া।ট্রাম্প সবসময়ই বিদেশে যুদ্ধ করা এড়িয়ে চলার অঙ্গীকার করে এসেছেন। ‘আমেরিকা সর্বাগ্রে’ নীতি নিয়ে তিনি বিচ্ছিন্নতার পথেই হেঁটেছেন। কিন্তু এবার তিনি পা দিয়ে দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পাতা ফাঁদে।
যে ফাঁদ এড়িয়ে চলেছিলেন ট্রাম্পের পূর্বসূরিরা। নেতানিয়াহু বরাবরই ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির হুমকিকে অতিরঞ্জিত করে দেখিয়ে এসেছে।ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যেসব তর্ক-বিতর্ক চলে এসেছে তা কখনও প্রমাণিত হয়নি। ইরান বরাবরই বলে এসেছে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ, তারা পারমাণবিক বোমা বানানোর চেষ্টা করছে না।গত সপ্তাহে ইসরায়েল একতরফাভাবে ইরানে আক্রমণ শানানোর পর এর যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে দাবি করে যে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞরা ইসরায়েলের এই যুক্তি সমর্থন করেনি। কিন্তু দুর্বলমনা ট্রাম্প তা বিশ্বাস করেছেন।নেতানিয়াহুর তৈরি করা স্ক্রিপ্ট থেকেই ট্রাম্প শনিবার রাতে ঘোষণায় পড়ে শুনিয়েছেন যে, “অকাট্য এই পারমাণবিক হুমকি দূর করা জরুরি। আর এটাই ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার একমাত্র লক্ষ্য।”সুতরাং আরও একবার একটা মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে জড়াল। যেরকমটি তারা জড়িয়েছিল ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধে।
ট্রাম্প এবং নেতানিয়াহু যাই কল্পনা করুন বা স্বপ্ন দেখুন না কেন, ইরান কোথাও হারিয়ে যাবে না। তারা এ অঞ্চলে একটি শক্তি হয়ে থাকবে মিত্র চীন, রাশিয়া এবং গ্লোবাল সাউথ-কে পাশে নিয়ে।
ইরান এরই মধ্যে তাদের বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ওপর জোর দিচ্ছে। ট্রাম্পের পূর্বসূরিরা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সমাধান যেখানে কূটনৈতিক পন্থায় করার চেষ্টা করেছিলেন, সেখানে ট্রাম্প এখন তা করতে নেমেছেন বোমা মেরে।শান্তি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি অধরাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। নেতানিয়াহু অবশ্য খুশি। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে নেমে পড়ায় এখন পিছু হটতে পারবে না।বিবিসি-র প্রধান আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা লিজ ডুসেট বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের ৪৫ বছরের টানাপোড়েনের মধ্যে এ ‘এক বড় মোড় পরিবর্তনের মুহূর্ত’।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র সীমারেখা অতিক্রম করেছে। লিজ ডুসেট বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের হামলা নিশ্চিতভাবে এই উত্তেজনাকে নতুন পরিস্থিতিতে ফেলেছে, যা খুবই অপ্রত্যাশিত এবং বিপজ্জনক।বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দীর্ঘমেয়াদে দু’ধরনের পরিণতি দেখা যেতে পারে। প্রথমত: ইরানে দুর্নীতি, সামরিক অদক্ষতা, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাসহ আরও নানা কারণে অজনপ্রিয় খামেনির শাসনব্যবস্থা লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং গাজার হামাসের সমর্থন বঞ্চিত অবস্থায় বিপর্যয়ের চাপে ভেঙে পড়তে পারে।
এখন পর্যন্ত ইরানে কোনও আন্দোলন বা সরকার পরিবর্তনের লক্ষণ তেমন দেখা যায়নি। তেহরান এবং অন্যান্য শহরে বোমা হামলা চলার মধ্যে এমন কিছু হলেও তা বিস্ময়কর হবে না। কিন্তু ইরানে শাসক্ষমতার পতনের বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
দ্বিতীয়ত: ট্রাম্প এবং নেতানিয়াহুর আল্টিমেটামের মুখে ইরান তাদের কাঙ্খিত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচির অধিকার পরিহার না করে বরং উল্টো পথেই হাঁটতে পারে।ইরানের শাসকরা, তারা যেই হোক না কেন, উত্তর কোরিয়ার পথ অনুসরণের সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং যত দ্রুত সম্ভব পারমাণবিক বোমা অর্জনের চেষ্টা নিতে পারে, যাতে অবিষ্যতে নাকাল না হতে হয়।
ইরান সেইপথে গেলে তারা পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) থেকে বেরিয়ে আসতে পারে এবং জাতিসংঘের আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) পরিদর্শকদের পারমাণবিক স্থাপনা পরিদর্শন কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করতে পারে।বছরের পর বছর ধরে পশ্চিমা নিয়মকানুনের সঙ্গে মানিয়ে চলার চেষ্টা করে আসা ইরান এখন শেষ পর্যন্ত সত্যিই দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে।
আর এই সব ঘটনা থেকে বিশ্বজুড়ে অন্যান্য দেশগুলোও নিজেদের প্রতিরক্ষায় পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের প্রয়োজনীয়তার কঠিন শিক্ষা নিতে পারে। আর তখন বিশ্বের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ হয়ে উঠতে পারে পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার।
ট্রাম্প এখন বেপরোয়াভাবে এবং সহিংস পন্থায় কেবল এমন একটি পারমাণবিক হুমকি দূর করার চেষ্টা করছেন, যেটি প্রমাণিত হয়নি।
কিন্তু তার এই পদক্ষেপ বিশ্বের পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ হওয়ার পথে হাঁটা নিশ্চিত করে তুলতে পারে এবং এই অস্ত্রের প্রমাণিত হুমকিকে আরও বাস্তব করে তুলতে পারে।

আরও পড়ুন