ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী : ঢাকায় যখন ইটের দালান হোয়াইট হাউস তখন কাঠের ঘর। চট্টগ্রামে যখন ইটের দালান ঢাকায় তখন কুড়েঘর। বাংলাদেশে যখন সেরা মসলিন (কাপড়) উৎপাদন হতো তখন পৃথিবীর প্রচুর মানুষ নগ্ন অর্ধনগ্ন থাকতো। বাংলাদেশের মসলিন, মুক্তা, মসলা জগৎখ্যাত ছিল। এসব পণ্যের আকর্ষণে দুই হাজার বছর পূর্বে ইউরোপের বণিকরা চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ বিড়িয়ে গর্বের সাথে ক্রয় করে তাদের দেশে নিয়ে যেতো। তারা তখন বাংলা বলতে চট্টগ্রামকে বুঝতো। তৎকালে চট্টগ্রামের সুগন্ধী, মসলিন, মুক্তা বন্দরের মাধ্যমে বিশ্ব বাজারে ছড়িয়ে পড়তো।
কথায় কথায় বলা হয় হাজার বছরের চট্টগ্রাম। কিন্তু ২০০৮ সালে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের মেধাবী ছাত্র মোহাম্মদ শাহীনুজ্জামান (শাহীন) তাঁর গবেষণায় প্রমাণ করেছেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক যুগেও মানব বসতি ছিল। নৃবিজ্ঞানী ও পত্নতত্ববিদগণ ধারণা করেন ৩/৪ হাজার বছর পূর্বেও চট্টগ্রামে মানব বসতি ছিল। মহাভারতের অনেক শ্লোকে চট্টগ্রামের আদিনাথ, চন্দ্রনাথ, কাঞ্চননাথ স্থানের কথা উল্লেখ রয়েছে। মহাভারত রচিত হয় সাড়ে ছয় হাজার বছর পূর্বে। তাহলে চট্টগ্রামের ইতিহাস সংস্কৃতি সাড়ে ছয় হাজার বছরের বেশী হবে না কেন?
সীতাকুণ্ড পর্বতস্তরে প্রাপ্ত হাতিয়ারদ্বারা ধারণা করা হয় চট্টগ্রামের বয়স ৫ হাজার বছর। কেউ কেউ বলেন, চট্টগ্রাম হাজার হাজার বছর পুরনো জনপদ হলেও চট্টগ্রাম নগরের বয়স ১২ শত বছর। যা হোক, চট্টগ্রাম আরব, বণিক, পূর্তগীজ, ডাচ,ফরাসি এবং সর্বশেষ ব্রিটিশদের পছন্দের শহর। প্রাচীন কালে এই বন্দর দিয়ে যত জাতির আগমন ঘটেছে, অন্য কোন শহরে এত জাতির প্রবেশ হয়েছে কিনা সংশয় রয়েছে। তার কারণে এখনো চট্টগ্রাম শহরের মানুষ মাল্টিকালচার। এ শহর বহু সভ্যতা সংস্কৃতি ধারণ করেছে
বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন শহরটির নাম ‘চট্টগ্রাম’।
গোবিন্দপুর, সুভালুটি ও কলকাতা এই তিনটি গ্রাম নিয়ে ১৬৯০ সালে চার্নক কলকাতা শহর প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা শহর সম্রাট জাহাঙ্গীর ও সুবেদার ইসলাম খাঁর আমলে প্রতিষ্ঠা হয় ১৬১০ খৃষ্টাব্দে। চট্টগ্রামে বসতি নয়, নগরই প্রতিষ্ঠা হয় ১২ শহ বছর পূর্বেই। এথচ লন্ডন নগরীর বয়স ৯০০ বছর। (সূত্র: প্রত্ন গবেষক শামসুল হোসাইনের লেখা, ‘এ অঞ্চল সবচেয়ে পুরোনো নগর চট্টগ্রাম’। দ্রঃ)
আল ইদ্রিসি, সোলাইমান আল তাজির এবং ইবনে খুরদবি প্রমূখ আরব ভূগোলবিদদের লেখায় চট্টগ্রামের সভ্যতা ও প্রাচীন শহর এবং মানব বসতি সম্পর্কে বর্ণনা পাওয়া যায়।
সুপরিকল্পিত মুদ্রা, ধাতব ও পাহারের ভাস্কর্যের নিদর্শন দ্বারা আরবের পর্যটক ও ভূগোলবিদরা অনুমান করেছেন, ৩/৪ হাজার বছর পূর্বে চট্টগ্রামে মানব বসতি ছিল। শুধু মানব বসতি ও নগর ছাড়াও সপ্তম শতাব্দীতে ‘হরিকেল’ নামক একটি রাজ্য কর্ণফুলির তীরে গড়ে উঠেছিল।
মুগল সুবেদার শায়েস্তা খাঁ চট্টগ্রামের নাম রাখেন ইসলামাবাদ। এটি পাকিস্তানের মরুভূমিতে গড়ে তোলা রাজধানী শহর ইসলামাবাদ নয়, এটি ভারত উপমহাদেশে প্রথম ইসলামের আগমনের তীর্থভূমি ইসলামাবাদ। হিজরতে পূর্বে ৬১৭ খৃষ্টাব্দে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ.)’র বংশধর বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবি ওয়াক্কাস মালিক ইবনে ওয়াহাব (র.)’র নেতৃত্বে সম্রাট নাজজাশির দেওয়া
জাহাজে করে চট্টগ্রামে প্রথম ইসলামের আগমন ঘটে। চট্টগ্রামে প্রচারিত ইসলাম মদিনার সমসাময়িক ইসলাম। প্রিয় নবী (দ.) মদিনায় হিজরতের পূর্বেই হযরত আবি ওয়াক্কাস (রা.)’র সাথে চার জন সাহাবায়ে রাসুল চট্টগ্রামে আসেন। চার জনের দুইজনের দুই জন সাহাবীর কবর চীনে চিহ্নিত আছে। আর দুই জন সাহাবী চট্টগ্রামের পূন্য মাটিতে শুয়ে আছেন। তাদের কবর নির্ধারণ করা যায়নি। মদিনার সাথে ইসলামের বাণী বহুদূরের পথ চট্টগ্রামে আগমন করা চট্টগ্রামবাসীর জন্য ভাগ্যের বিষয়। হযরত আবি ওয়াক্কাস (রা.) সাথে যে চারজন সাহাবী চট্টগ্রামে আগমন করেছিলেন তাঁদের নাম (১) হযরত তামীম আনসারী (রা.), (২) হযরত কায়েস ইবনে ছায়াফরি (রা.), (৩) হযরত উরওয়াহ ইবনে আছম (রা.), (৪) হযরত আবু কায়েস হারিস (রা.)। তাঁরা চট্টগ্রামে চার বছর অস্থানের পরই চীনে গমন করেন
একদিন ফজরের নামাজের পর মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ.) মসজিদে নববীর ছাদে উঠে চারদিকে তাকিয়ে পূর্বদিকে মুখ মোবারক স্থির করে লম্বালম্বা নিঃশ্বাস নিলেন। সাহাবায়ে কেরাম তার কারণ জানতে চাইলেন। প্রিয় নবী (দ.) জানালেন, এইদিকে হাজার হাজার মাইল দূরে হিন্দুস্থান নামক একটি জায়গা আছে,যে জায়গায় আমার প্রেমিক আছে, পাগল আছে, আমি হাজার বছর আগেই তাদের খুশবু পাচ্ছি। তাই মনের আনন্দে খুশবু নিচ্ছি। এই সুগন্ধের শুরু হয় নবী পাক (দ.)’র বংশধর সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)’র আগমনের সময় হতে।
অনেকে বলে থাকেন, ভারত উপমহাদেশে কেরালা রাজ্যে সর্ব প্রথম হযরত মালিক ইবনে দিনার (রা.) ইসলামের বাণী নিয়ে আসেন কিন্তু মালিক ইবনে দিনার (রা.) কেরালায় আগমন করেন ৬৪৩ খ্রীষ্টাব্দে। তার ২২ বছর পূর্বেই হযরত আবি ওয়াক্কাস মালিক ইবনে ওয়াকার (রা.) চট্টগ্রামে ইসলামের বাণী নিয়ে আসেন।
হযরত মালিক ইবনে দিনার (রা.) কেরালায় ইসলাম প্রচারের বিষয়টি এখানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা প্রয়োজন। মালিক ইবনে দিনার (রা.) ভারত উপমহাদেশে প্রথম ইসলাম প্রচারকারী নন, প্রথম মসজিদ প্রতিষ্ঠাকারী ছিলেন। ভারত উপহমাদেশে প্রথম তিনি কেরালা রাজ্যে ‘চেরামন জামে মসজিদ’ প্রতিষ্ঠা করেন। শিলালিপির ভাষ্য দ্বারা জানা যায় ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে সাহাবী হযরত মলিক ইবনে দিনার (রা.) (ইন্তেকাল: ১৩০ হিজরী) মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন।
ইতিহাস হতে আমরা জানতে পারি, প্রাচীনকাল হতে কেরালা রাজ্যের সাথে ভারত মহাসাগর ও আবর উপসাগরের সমুদ্র উপকূলীয় হওয়ার কারণে আরবের সাথে কেরালার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভাল ছিল। কেরালার রাজা চেরামন পেরুমন আরব ব্যবসায়ীর নিকট ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ইসলামের বাণিজ্যিক কাফেলার সাথে আরবে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তাজউদ্দিন নাম ধারণ করেন। ঐতিহাসিকগণ বলেছেন, রাজা পেরুমন মহানবী (দ.)’র আঙুলের ইশারায় চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হতে দেখেছেন। এই বিষয়টি কেন হলো তিনি তাঁর রাজ্যের পুরোহিতের নিকট জানতে চেয়েছিলেন, তারা কোন সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। পরে আরবে গিয়ে নবী পাক (দ.) নিকট ইসলাম গ্রহণ করেন।
হাদিসে বর্ণনা আছে এই রাজা প্রিয় নবী (দ.)’র নিকট আদাভর্তি একটি কলসী উপহার পাঠান। প্রিয় নবী (দ.) প্রত্যেককে এক টুকরো করে খেতে দেন। হাদিস বর্ণনাকারী হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন, প্রিয় নবী (দ.) আমাকেও এক টুকরো দিয়েছিলেন। রাজা পেরুমন ইসলাম ধর্মগ্রহণ করার পর কয়েকজন সাহাবায়ে রাসুলকে নিয়ে তিনি কেরালায় আসেন। তাদের সাথে ছিলেন মহানবী (দ.)’র অন্যতম সাহাবী হযরত মালিক ইবনে দিনার (রা.)। আরব হতে ফেরার সময় রাজা চেরামন ইন্তেকাল করেন। সাহাবী মালিক ইবনে দিনার (রা.) কেরালায় ফিরে এসে রাজার নামে ‘চেরামন মসজিদ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই ভারত উপমহাদেশের প্রথম মসজিদ। চট্টগ্রামে দ্বিতীয় পর্যায়ে আমিরুল মোমেনিন হযরত ওমর ফারুক (রা.)’র শাসনামলে সাতজন তাবেয়ীর একটি দল ইসলাম প্রচারের লক্ষ্যে চট্টগ্রামে আগমন করেন। তারা হলেন, (১) হযরত মোহাম্মদ মামুন, (২) হযরত মোহাম্মদ মোহাইমেন (রা.), (৩) হযরত আবু তালেব (রা.), (৪) হযরত মোহাম্মদ মুর্তুজা (রা.), (৫) হযরত আবদুল্লাহ (রা.), (৬) হযরত হামিদ উদ্দিন (রা.), (৭) হযরত হোসেন ইদ্দিন (রা.)। তারা সবাই মিলে, নওমুসলিমদের সাথে নিয়ে চট্টগ্রামের দেয়াং পাহাড়ে ঈদের জামাত আদায় করেন। এটিই ছিল ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ঈদের জামাত।লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিক
