২৪শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

মেধাবী নয়, দেশপ্রেমিক প্রয়োজন

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী: আজ আমরা সবাই মেধার পিছনে ছুটছি। আমাদের সন্তানদের মেধাবী করতে সবকিছু ত্যাগ করতে রাজি। দেশে মেধাবী অমানুষ দেখতে দেখতে দেশপ্রেমিক মানুষের কথা ভুলে যাচ্ছি। দেশের প্রকৃত উন্নতি চাইলে মেধাবী হওয়ার চেয়ে দেশপ্রেমিক মানুষ হওয়া বড় বেশি প্রয়োজন অনুভব করছি। দেশে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মেধাবীর সংখ্যা বাড়ছে। মেধাবীর ঠেলায় দেশপ্রেমিক মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে। দেশপ্রেমিক মানুষ হতে হলে মনুষ্যত্বের শিক্ষা চর্চা করতে হয়।যা বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় অনুপস্থিত। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই চরম শিক্ষা, আর সমস্তই তার অধীন’। আধুনিক বিশ্বে উন্নতি মানে ‘হিউম্যান ডেপল্যাপম্যান্ট’। মেধাবী হলে উন্নত বলা যাবে না। ম্যানকে হিউম্যানে পরিণত করাই প্রকৃত উন্নতি। ব্রেলিয়ারা শুধুই কেরিয়ার তৈরী করতে ব্যস্ত থাকে। তারা পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পায়, বিদেশের ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পায়, ভালো চাকুরী পায়, বাড়ি গাড়ি নারী ভালো পায়, অনেক তাদের বেতন, তারা দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ায়,তাদের অনেক অহংকার, তাদের সুখই মুখ্য বিষয়। তারা সুখে থাকতে থাকতে দেশের কথা, এমন কী তাদের মা বাবা ভাই-বোন সবার কথা ভুলে যায়। তাদের অনেকের মা বাবার স্থান হয় বুদ্ধাশ্রমে। ধনীর মা বাবা যায় বৃদ্ধাশ্রমে আর গরিবের সন্তান যায় এতিমখানায়। মেধাবীদের ইমোশন নেই, তারা প্রমোশনের পাগল। তারা অতীতের দুঃখের জীবন নিয়ে ভাবে না, তারা শুধু ভাবে ভবিষ্যত নিয়ে। তাদের স্বপ্ন শুধু ফিউচার আর ফিউচার।তারা বুলবুলির মত সৌন্দর্য খুঁজে না, শকুনের মত দৃষ্টি থাকে মরা গরুর দিকে।মেধাবীর দৃষ্টি ছোট চেয়ার হতে বড় চেয়ারের দিকে থাকে।তাদের গান আর কবিতা শুনার সময় নেই। উপন্যাস পড়া, মুক্ত আকাশের দিকে থাকানো, সাগরতীর দেখা, বৃষ্টিতে মন খারাপ করা আর সবুজ ঘাস ও প্রকৃতি আকর্ষণ করার ক্ষমতা তারা হারিয়ে ফেলেছে। তারা যান্ত্রিক যুগের আন্তরিকহীন অমানুষ। আজ আমরা ঘরে ঘরে ব্রিলিয়ান অমানুষ গড়ে তুলতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। মেধাবীরা নিজের জন্য, নিজের পেট ভর্তির জন্য মেধাবী হয়।প্রকৃত শিক্ষা কখনো নিজের পেট ভর্তির জন্য হয় না। জীবনের জন্য শিক্ষা অর্জন করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, শিক্ষা হতে হবে জীবনের খাদ্য। মনীষী টলেস্টয় বলেগেছেন, জীবন যাপনের জ্ঞানই প্রকৃত বিজ্ঞান,এই বিজ্ঞান সমস্ত মানুষের বিজ্ঞান। প্রকৃত মানুষ বিবেকহীন হতে পারে না। মেধাবী হয়ে কী ভাবে তারা বিবেকহীন হয় তা আমার মাথায় আসে না। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক বার বার মানুষের বিবেককে জাগ্রত করতে বলা হয়েছে। বিবেকহীন মানুষ মেধাবী হলেও পশুর সমান।
পবিত্র কোরআনে ‘আকল’ বা বিবেক শব্দটি ৭০ বার এসেছে। এই আকলের উৎপত্তি হৃদয় হতে। এই জ্ঞানের জন্য হৃদয়ের পরিশুদ্ধতা প্রয়োজন হয়।তথ্য থাকলে শিক্ষা বলা যায় না, সত্য থাকতে হয়। সক্রেটিস বলতেন, ‘শিক্ষা হলো মিথ্যার অপমোদন এবং সত্যের আবিষ্কার’। তাঁর ছাত্র প্লেটোর মতে ‘শিক্ষা হলো একটি শক্তি যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মোপলব্ধির জন্ম দেয়’। প্লেটোর ছাত্র এরিস্টটরের মতে, ‘সুস্থদেহে সুস্থ মন তৈরী করার নামই শিক্ষা’। মেধার সাথে মনন ও প্রজ্ঞার সমন্বয় না হলে সে মেধ্য পথভ্রষ্ট করে।
বর্তমান শিক্ষা বাজারমুখী।এখন শিক্ষকের শিক্ষা দ্বারা ছাত্রদের আলোকিত করে না, শিক্ষা পণ্যের মত বিক্রি হয়। হযরত শেখ সাদী (রহ.) বহু বছর আগে বলে গেছেন, এখন শিক্ষকের নিকট জ্ঞান আহরণ করতে মানুষ আসে। এমন একদিন আসবে যখন বিদ্যা বিক্রির জন্য মানুষ ঘরে ঘরে যাবে। এখন প্রচুর শিক্ষক ছাত্রের গৃহে গিয়ে টাকার পরিমাণ করে জ্ঞান বিতরণ করে আসে। প্রাচীন কালে ছিল আহার সঞ্চায়ের শিক্ষা, তারপর নিরাপত্তার অস্ত্র প্রশিক্ষণের শিক্ষা, তারপর শাস্ত্র জ্ঞান অর্জনের শিক্ষা। এসব পথ পরিক্রমায় বর্তমান সময়ে জীবনবোধের শিক্ষায় পৌঁছেছি। প্রকৃত পক্ষে জীবনবোধের শিক্ষা আত্মস্থ করার ব্যবস্থা ও ক্ষমতা আমাদের হয়ে উঠছে না।
সরদার ফজলুল করিম বলেছেন, ‘একজন ছাত্র আমাকে বলেন, স্যার, এমন একটা বইয়ের নাম বলেন, যে বইয়ে সব আছে। তখন আমি বললাম, কাগজ কলম নাও, লেখ, ‘জীবন’।সে বলল, স্যার, এ বইয়ের লেখকের নাম কী? আমি বললাম, ‘জীবন দত্ত’।জীবনের সহজ কোন সংজ্ঞা নেই। তুমি এমন কোন অভিধান পাইবা না, যাতে জীবনের সহজ অর্থ আছে। তুমি জীবনের মত সহজ অর্থ খোঁজ কর কেন? জীবনকে বুঝতে একজন মনীষীকে বুঝলে হবে না। বহু মনীষীর বহু বৈচিত্র্যময় জীবনকে বুঝতে হয়। তাই জ্ঞানীরা বলেগেছেন, একজন লোকের কমপক্ষে ত্রিশজন মনীষীর জীবন পাঠ করা প্রয়োজন। আজকের তথ্য প্রবাহের যুগে ত্রিশজন নয়, তিনশত মনীষীর জীবনী পাঠ করা কঠিন নয়।ইন্টারনেটের কল্যাণে হাজার জীবনী আমাদের হাতের মুঠোয় কিন্তু আমাদের সন্তানরা ২/১টি জীবনী
পাঠ করতে রাজি নয়। তাই জীবনকে বুঝা তাদের পক্ষে কঠিন। শুধু মেধাবী হলে হয় না, মেধাকে জীবনে প্রয়োগের উপায় জানতে হয়। এখন মেধাবী সংখ্যা কম নয়, কিন্তু মেধাকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগকারী মানুষের সংখ্যা খুবই কম। বাস্তব জীবনে মেধাবী যে সকল সফল মানুষ মেধাকে কাজে লাগিয়েছেন তাদের জীবন অনুসরণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
মেধাবীদের দৃষ্টি থাকে ক্যারিয়ার আর ক্যারিয়ারের দিকে।ভোগ বিলাসী জীবনের দিকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা দেশ জাতি প্রকৃতির কান্না শুনতে পায় না। ছায়া মায়া ভরা ছয় ঋতুর প্রকৃতি তাদের আকর্ষণ করে না। কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর বাঙালির বাঙলা, প্রবন্ধে লেখেছেন, ‘এত ফুল এত ফল, এত ছায়া,এত মায়া, এত পাখি,এত গান, এত সুর, এত স্বর, এত কুঞ্জ, এত ধর্ম,এত উপসনা, এত উৎসব পৃথিবীর কোথায় আছে? বাংলার মাঠে মাঠে ধেনু, ছাগ, মহিষ নদী বিলে ঝিলে পুকুরে ডোবায় আছে মাছ। আমাদের মাতৃভূমি স্বর্গতুল্য। আমাদের অভাব কোথায়? অতি প্রাচুর্য আমাদের বিলাসী ও ভোগী করে তুলেছে এবং কর্মবিমুখ জাতিতে পরিণত করেছে’।
এসব সৌন্দর্য অনুধাবন করতে কবি কাজী নজরুল ইসলামের মত অন্তর দৃষ্টির প্রয়োজন। সৌন্দর্য কোপালের চোখে নয়, অন্তরের চোখ দ্বারা অবলোকন করতে হয়। মেধাবীরা জ্ঞান বিজ্ঞানের দিকে দৃষ্টি দিতে দিতে তাদের হৃদয়টাকে মেরে ফেলছে। জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা একবার জানা হয়ে গেলে আর জানতে হয় না, পুরাতন হয়ে যায়। কিন্তু হৃদয়ের কথা, ভাবের কথা কখনো পুরাণ হয় না, নিত্য নতুন রস নিয়ে হাজির হয়। তাই একটি কবিতা বার বার পড়তে হয়, একটি গান বারবার শুনতে হয়। একটি দৃশ্য বারবার দেখতে হয়। ভাবের সঙ্গে ভাষার, জ্ঞানের সঙ্গে রসের, কালের সাথে মহাকালের, লেখকের সাথে পাঠকের যে ভাব মিলন সাহিত্য ঘটান, তা কী আজকের তথাকথিত মেধাবীদের আকর্ষণ করে?
গাদা গাদা বই পড়ে, শত শত বক্তব্য বয়ান শুনে বহু মানুষের জীবন পরিবর্তন হয়নি। আর অন্তদৃষ্টি দিয়ে অবলোকন করার কারণে একটি ঘটনা, একটি দৃশ্য পুরো দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে দিতে দেখেছি। দৃষ্টিভঙ্গি বদলালেই জীবন বদলে যায়।
দুনিয়ার সবচেয়ে বড় এনজিও ব্র্যাক। এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হোসেন আবেদ। সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে সর্বস্ব হারানো মানুষের জন্য ঘর নির্মাণ ও ত্রাণ কার্য চালাতে গিয়ে তাঁর দৃষ্টি ভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে যায়। তখন তাঁর মনে হয়, অসহায় সাধারণ মানুষ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যে জীবন তিনি যাপন করছেন তা জীবন নয়, এই ভাবনাটাই তাঁর জীবনের গতিপথ পরিবর্তণ করে দেয়। তখন থেকে সিদ্ধান্ত নেন, তিনি তাঁর জীবনটা দরিদ্র মানুষের জন্য উৎসর্গ করবেন। তখনই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তিনি জীবনে কোনদিন গাড়ি, বাড়ির মালিক হবেন না, অর্থ সম্পদ নিজের জন্য সঞ্চয় করবেন না। সে সংকল্প তিনি শেষ পর্যন্ত রক্ষা করেছিলেন। তিনি বড় লোক ছিলেন না, বড় মানুষ ছিলেন। কথা সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর একটি সাড়া জাগানো কথা দিয়ে আজকের রেখার ইতি টানতে চাই। তিনি বলেছেন, বড় বড় সার্টিফিকেট দিয়ে কী হবে, যদি মনটা অশিক্ষিত থাকে’। আমি বহু সার্টিফিকেটধারী লোক দেখেছি তাদের মনটা পূর্ণ অশিক্ষিত।তারা শিক্ষিত হয়েছে কিন্তু মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি।
লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিক

আরও পড়ুন